‘পানি সংকটে’ দুর্গম পাহাড়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে বহু গুণ

0
32

আকাশ মারমা মংসিং।।বান্দরবান ||

গ্রীষ্মকালের তাপদাহের ফলে পানি সংকট দেখা দিয়েছে পুরো পাহাড় জুড়ে। বান্দরবান জেলার প্রান্তিক দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারীদের পানির প্রধান উৎস নদী ও ঝিরি-ঝর্ণা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দুর্গম এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ও ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামার ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুপেয় পানি থেকে নিত্য ব্যবহার্য পানিও মিলছে না। গ্রীষ্মে তাপদাহে এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা, নালা। তাছাড়া সেসব দুষিত পানি পান করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ওই সমস্ত এলাকার বাসিন্দারা। দূর-দূরন্ত থেকে অনেক কষ্টে পানি সংগ্রহ করে এনে খাওয়াসহ রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে সেখানকার মানুষদের। ফলে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের কষ্ট বহু গুণ বেড়েছে।

বান্দরবান জেলায় অন্তর্গত চিম্বুক, ম্রোলং পাড়া, টংকাবতী, মাঝের পাড়া, রেইছা, টিএন্ডটি পাড়া ও সদরসহ সাতটি উপজেলায় দুর্গম এলাকা গুলোতে এখন পানির সংকটের চিত্র। সেসব দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠিদের প্রধান উৎস ঝিড়ি-ঝর্ণা কিংবা খালের কুয়া। ছড়াগুলো শুকিয়ে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পানি উঠছে না। তাছাড়া প্রকৃতির সবুজ ঘেরা বনাঞ্চল উজার করে দেয়াই ঝিড়িগুলোতে পানি দেখা মিলছেনা। যার ফলে সুপেয় পানি থেকে নিত্য ব্যবহার্য পানিও এখন চরম সংকটে। তাছাড়া এই পানি সংকট নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও মাল্টিমিডিয়াতে বারবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও মেলেনি কোন সুফল। বরংচ দিনের পর দিন আরো তীব্র আকারে ধারণ করেই চলেছে খাবার কিংবা নিত্য ব্যবহার্য।

বান্দরবান সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে টংকাবতী ইউনিয়ন। সেখানে কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বসবাস করে আসছেন ম্রো সম্প্রদায়। তাদের মুলত সমস্যা কারণ খাবার পানি । সকাল থেকে কলসিসহ বিভিন্ন খালি বোতল নিয়ে এসে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় কয়েক ঘন্টা। এই সময়ে নারীরা মধ্যরাত থেকে পালা করে ভোর পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে কোনোমতে পরিবারের খাবারের পানি সংগ্রহ করে আনেন। ঝিরি ও ছড়ায় পাথরের ফাঁকে অল্প অল্প করে পানি আসে।

টংকাবতী ইউনিয়নের বাট্টা পাড়া গ্রামে ম্রো নারীরা একসঙ্গে পাঁচ-ছয়জন দলবেঁধে ঝিড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করতে এসেছেন ভোর বেলায়। ঝিরিটি একটু স্যাঁতস্যাঁতে ও ভেজা। পাথরের মাঝখান দিয়ে খুব অল্প করে পানি বের হয়। পানি জমতে একটু সময় লাগে। দুই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কপালে জুটে ময়লা যুক্ত পানি। পর্যায়ক্রমে দুই-তিনজন করে পানি নিতে আসেন অনান্য নারীরাও। সকালে অন্য কাউকে পানি নেওয়ার সুযোগ দিয়ে ঘরে অন্যান্য কাজ সেরে একটু দেরি করে পানি সংগ্রহ করতে যান তারা। সেখান থেকে প্রথমে মগে পানি তোলা হয়, তারপর ছেঁকে কলসিতে সংগ্রহ করা হয়। পরপর দুই মগ পানি নেওয়ার পর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এক লিটার, দুই লিটারের বোতলে ঝিরির পানি ভরে থুরুংয়ে (ঝুড়ি) করে উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে ঘরে ফেরেন নারীরা। তবুও এসব ঝিরি-ঝর্ণা ওপর ভরসা করে চলছে জীবনের সংগ্রাম।

বন ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাহাড়েও বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। অবাধে ধ্বংস করা হচ্ছে বন। এসব কারণে পাহাড়ের পানির প্রাকৃতিক জলাধার ও উৎসমুখ দিনে দিনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর জনস্বাস্থ্যের উপর।

দূর্গম এলাকার বসবাসকারীরা বলছেন, তীব্র পানি সংকট যেন দিনের পর দিন বাড়ছে। প্রকৃতির ধ্বসের কারণের পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় এখন হুমকির মুখে। বন উজার, পাহাড় কর্তন, পাথর উত্তোলনের কারণে পাহাড় এখন মরুভূমিতে পরিণত হছে। তাছাড়া এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে উচ্চস্থ প্রভাবশালীরা। যদি সেসব কাজ বন্ধ করা না গেলে পানির জন্য হাহাকার হয়ে মৃত্যু মিছিল হবে। তাদের অভিযোগ- আগের মতো বড় বড় গাছ না থাকায় ও বন উজারের ফলে এই পানি সংকট তীব্র আকারে ধারণ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান শাখার সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, এক সময় ঘন জঙ্গল ও পাথরে ভরা ছিল এই বান্দরবান। উন্নয়নের জন্য অবাদে পাথর উত্তোলন, ব্যবসায়িক স্বার্থে জোত পারমিটের নামে নির্বিচারে গাছকাটা, বান্দরবানের পরিবেশকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। ফলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে কমছে পানির প্রবাহ। আগামীতে সেসব পাহাড়ের পানি থাকবে কীনা সেটি বড় প্রশ্ন।

বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তথ্য মতে, পুরো সাত উপজেলায় এই পর্যন্ত নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে ৫শত অধিক। কিন্তু পানি স্তর নেমে যাওয়াই সেসব নলকুপ এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাছাড়া পানি সংকট নিরসনের দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে সেটি এখনো অনিশ্চিত।

মাঝের পাড়া বাসিন্দা শৈউসিং মারমা বলেন, এই গরমের পুরো গ্রাম পানি জন্য হাহাকার অবস্থা। ময়লা পানিতে করতে হচ্ছে গোসল। তাছাড়া খালের চারিপাশে ময়লাস্তুপ। ভবিষ্যতে পাহাড়ের কি হবে এই চিন্তায় আছি।

হেডম্যান পাড়া ইউপি সদস্য রেদা মং মারমা বলেন, পাথর বন উজার করার ফলে পানি এখন নাই বললেই চলে। গোসল দুরের কথা খাওয়ার পানি পর্যন্ত সংকট। সন্ধায় হলে পানির জন্য লাইন পড়ে যায়। তাছাড়া এনজিও বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নলকুপ দিলেও সেগুলো পরে অকেজো হয়ে পড়েছে। কারণ ১০০ফুট জায়গায় পাইপ দেয়া হয়েছে ৪৫ ফুট।

এবিষয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, বান্দরবানে দুর্গম পাহাড়ের সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জন্য এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে পানি সংকট নিরাসনে জন্য বাস্তবায়িত করা হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here