সুরো কৃষ্ণ এখন সেরা বক্সার

0
40

 

পেশাদার বক্সিংয়ে সেরা সুরো কৃষ্ণনিউজ ডেক্স।।

১৯৮৬ সালে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের বক্সার মোশাররফ হোসেন ব্রোঞ্জ পেয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তার প্রায় তিন যুগ পর ২০২২ সালে এসে সুরো কৃষ্ণ এবং আল আমিনরা কিছুটা হলেও বক্সিংকে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন। ১৯ মে রাজধানীর মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বক্সিং ফাউন্ডেশন বা বিবিএফের আয়োজনে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের মোট ১৪ জন বক্সারের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় সাউথ এশিয়ান প্রফেশনাল বক্সিং ফাইট নাইট-দ্য আলটিমেট গ্লোরি চ্যাম্পিয়নশিপ। এতে চার রাউন্ডের খেলায় ৬১ কেজি ওজন শ্রেণিতে সুরো কৃষ্ণ চাকমা নেপালের আট বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মাহেন্দ্র বাহাদুর চান্দকে পরাজিত করে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পেশাদার বক্সিংয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশও পেশাদার বক্সিং জগতে প্রবেশ করল।

জুরাছড়ি থেকে লন্ডন
রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুরো কৃষ্ণ ২০০৭ সালে বিকেএসপিতে কোচ আবু সুফিয়ান চিশতির অধীনে বক্সিংয়ে ভর্তি হন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৫ জন কোচের অধীনে কাজ করেছেন। ছয় বছর কঠোর সাধনার পর বক্সিংয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণপদক অর্জন করেন সুরো। ২০১৪ সালে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নও হন তিনি। নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমস-২০১৯ অ্যামেচার বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জপদক পান। এ ছাড়াও ২০১৮ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে দুই খেলায় জয়লাভ করেন। তার নিজস্ব প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্ট ছিল ২০১৪ সালের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমস। এর বাইরেও ২০১৫ সালে দেশসেরা বক্সার নির্বাচিত হয়ে লন্ডনে ছয় মাসের এক ট্রেনিং করার সুযোগ পান। লন্ডনে গিয়ে বুঝতে পারেন পেশাদার বক্সিংয়ের জগৎটা কত বড়। হাজার কোটি টাকার পুরস্কার ও টুর্নামেন্ট। তখন থেকেই নিজেকে পেশাদার বক্সিংয়ের জন্য তৈরি করতে শুরু করেন সুরো কৃষ্ণ।

ফুটবলার না হয়ে বক্সার
সুরো কৃষ্ণ চাকমা ছোটবেলা থেকে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে ভাগ্য তাকে ঠেলে দিয়েছে বক্সিংয়ের রিংয়ে। পায়ের বদলে হাত দিয়েই বাজিমাত সুরো কৃষ্ণের। সুরো কৃষ্ণ বলেন, ‘ফুটবল খুব ভালো লাগত। বাবা ছিলেন ফুটবলার। তাই আমিও বাবার মতো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। বিকেএসপিতে ফুটবলার হতে পরীক্ষাও দিয়েছি। উচ্চতা কিছুটা কম থাকায় সেখানে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারিনি। ফুটবলের পাশাপাশি বক্সিংও আমার ভালো লাগত। ফুটবলে যখন বিকেএসপিতে টিকলাম না, তখন বক্সিংয়ে পরীক্ষা দিয়ে টিকলাম। বক্সিংয়ে যখন বিকেএসপিতে ছিলাম, তখনই ইচ্ছে ছিল দেশের শীর্ষ খেলোয়াড় হবো। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মানবিক মূল্যবোধের পাঠ
বিকেএসপির পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন সুরো কৃষ্ণ। কেন এবং কোন বিষয়ে পড়েছেন- এই প্রশ্ন করলে সুরো কৃষ্ণ বলেন, ‘আসলে আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বিকেএসপির খেলোয়াড় কোটার মাধ্যমে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। এই বিষয় আমার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলেনি। বিষয়টি নিয়ে আমার মধ্যে কখনও অস্বস্তিও কাজ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমি উপভোগ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, জিমনেসিয়াম, জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবনের ৪১২ নম্বর রুম আর ক্যাম্পাস উপভোগ করতে করতেই একাডেমিক পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়! তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আমাকে একজন প্রকৃত বক্সার এবং খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতে সহায়তা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফলে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলো আমি অর্জন করতে পেরেছি; যা একজন খেলোয়াড়ের অবশ্যই প্রয়োজন।’

পেশাদার বক্সিং মানেই ঝুঁকি- এ কথা প্রসঙ্গে সুরো কৃষ্ণ বলেন, ‘জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত মানুষ ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যায়। সব কাজেই ঝুঁকি থাকে। তবে এটা ঠিক যে, অ্যামেচার বক্সিংয়ের তুলনায় পেশাদার বক্সিংয়ে ঝুঁকি বেশি। এখানে প্রটেকশন কম কিন্তু ফাইট বেশি। তবু বক্সিংয়ের রিংই এক প্রকার জীবন। এই জীবনে বাঁচতে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। কখনও লড়তে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আবার শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে।’ তবে বক্সিং অনেক শান্ত করেছে সুরো কৃষ্ণকে- এ কথা মেনে নিয়ে বলেন, ‘বক্সিংয়ে আসার পর আমার অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে হুটহাট যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম; যার ফল ভালো হতো না। এখন ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জীবন বাস্তবতার সঙ্গে আবার বক্সিং রিংকে মেলানো যাবে না। কেননা, রিংয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় খুব দ্রুত। অন্য খেলার তুলনায় বক্সিংয়ে একজন বক্সার এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ব্যাকফুটে গিয়ে ডিফেন্স করবে, না অন্য হাত দিয়ে আক্রমণ করবে।’

আগামীর স্বপ্ন
আগামীর পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এখানেই থেমে থাকতে চাই না। যেতে চাই বহুদূর। উঠতে চাই চূড়ায়। তাই তো পেশাদার বক্সিংয়ে নাম লিখিয়েছি। মগজে গেঁথে নিয়েছি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন। তবে এর জন্য প্রয়োজন আরও উন্নত ট্রেনিং এবং সুযোগ-সুবিধার। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে পেশাদার বক্সিংয়ে এসেছি। আলী জ্যাকোই আমাকে এই পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছেন। আমি চাই দেশের সম্মান আরও বাড়াতে। দেশের পতাকা নিয়ে খেলে সম্মান বয়ে আনতে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন লালন করি। তবে আপাতত আমি আরও বেশি পেশাদার ম্যাচ খেলে এশিয়া টাইটেল জয় করতে চাই। এশিয়া টাইটেল হলো এশিয়ার বক্সিংয়ে বিশ্বকাপ জয় করার মতো। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজ জেলা রাঙামাটিতে একটি বক্সিং একাডেমি করতে চাই। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় সেখানে বক্সিংয়ের তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। শুধু রাঙামাটি কেন ঢাকার বাইরে রাজশাহী ছাড়া তেমন কোথাও বক্সিংয়ের রিং নেই। তাই রাঙামাটিতে বক্সিং একাডেমি গড়ে তুলতে চাই। আর আমার খেলার শিকড় যেহেতু বিকেএসপিতে, তাই সব চাওয়াই বক্সিং বা খেলাধুলাকেন্দ্রিক। সহজ করে বললে বক্সিংয়ের সঙ্গেই থাকতে চাই।’

সুরো কৃষ্ণের হাত ধরে বক্সিং রিংয়ে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা- এমন স্বপ্ন দেখতেই পারেন মোহাম্মদ আলী ও মোশাররফ হোসেনের উত্তরসূরিরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here