
মংহাইথুই মারমা।। নির্বাহী সম্পাদক।।
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পাহাড়, নদী, সবুজ বন আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অনন্য অঞ্চল। তবে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও সীমান্তবর্তী অবস্থানের কারণে এই এলাকা সবসময়ই ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে সেনাবাহিনী গত কয়েক দশক ধরে যে অবদান রেখে আসছে, তা প্রশংসার দাবিদার। তারা শুধু অস্ত্রধারী বাহিনী নয়, বরং মানবিক সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নিরাপত্তার অটল প্রহরী:
পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মাদক পাচার ও সশস্ত্র অপরাধের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। সেনাবাহিনী সর্বদা পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় নিয়মিত টহল দিয়ে এসব অপরাধ প্রতিরোধ করছে।
দুর্গম রুমা, থানচি, বাঘাইহাট বা নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত ঘেঁষা জনপদে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি স্থানীয়দের মাঝে এক ধরনের নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ি ও বাঙালি—উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই মনে করেন, সেনাবাহিনীর টহল থাকায় চাঁদাবাজি ও সহিংসতা অনেকটাই কমে গেছে।
উন্নয়নের সহযাত্রী:
পাহাড়ি এলাকায় উন্নয়নের অন্যতম বড় বাধা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা। সেনাবাহিনী নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মাধ্যমে দুর্গম পাহাড়ি গ্রামকে মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত করছে। বান্দরবানের থানচি-আলীকদম ৩৫ কিলোমিটার সড়ক, রাঙামাটির সাজেক সড়ক, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা-মহালছড়ি সড়ক—সবগুলোই সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্মিত। এই সড়কগুলো শুধু বাণিজ্য ও পর্যটনের সুযোগই বাড়ায়নি, বরং দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসা ও শিক্ষাসুবিধা পেতে সহজ করেছে।
মানবিক ও চিকিৎসা সেবা:
সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে দুর্গম গ্রামে গিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির আয়োজন করে। অনেক এলাকায় সরকারি হাসপাতাল দূরে থাকায় সেনা পরিচালিত মেডিকেল ক্যাম্পই স্থানীয়দের একমাত্র ভরসা। প্রতিবছর হাজারো মানুষ সেনাবাহিনীর দেওয়া চিকিৎসা সেবা পান। বিশেষ করে শিশুদের টিকা, গর্ভবতী মায়েদের সেবা এবং জরুরি রোগীদের সেনা অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া—এসব কার্যক্রম স্থানীয়দের মনে গভীর আস্থা সৃষ্টি করেছে।
দুর্যোগে সর্বাগ্রে সেনাবাহিনী:
ভূমিধস, বন্যা বা পাহাড় ধসে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হলে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ ভূমিধসে রাঙামাটি ও বান্দরবানে সেনা সদস্যরা রাতদিন কাজ করে বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের দ্রুত পদক্ষেপ ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার মানসিকতা প্রমাণ করে, সেনাবাহিনী শুধু শান্তিকালেই নয়, দুর্যোগকালেও জনগণের সবচেয়ে বড় ভরসা।
শিক্ষা ও ক্রীড়া উন্নয়ন:
সেনাবাহিনী পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। দুর্গম এলাকায় তারা স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে আসছে।
এছাড়া, স্থানীয় যুবকদের ক্রীড়াক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে ফুটবল, ভলিবল ও অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে থাকে। এতে পাহাড়ি তরুণদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পর্যটন সম্ভাবনা উন্মোচন:
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, কেওক্রাডং কিংবা রাঙামাটির সাজেক এখন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এসব স্থানের নিরাপত্তা ও অবকাঠামো উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
সামাজিক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন:
পাহাড়ে সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তা দেয় না, বরং স্থানীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, ঈদ কিংবা বিজয় দিবস—সব উৎসবেই স্থানীয়দের সঙ্গে মিলে অনুষ্ঠান পালন করে। এতে পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পায়।
বান্দরবানের এক মারমা প্রবীণ বলেন, “সেনারা আমাদের অনুষ্ঠানে এসে গান গায়, খেলায় অংশ নেয়—এটা আমাদের জন্য আনন্দের।”
শান্তি ও স্থিতিশীলতার রক্ষক:
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর সেনাবাহিনী পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় আগের মতো সংঘাত নেই, যা সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার ফল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কেবল সামরিক বাহিনী নয়—তারা উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং বন্ধু। পাহাড়ের দুর্গমতা, চ্যালেঞ্জ ও বৈচিত্র্যের মাঝেও তারা নিরাপত্তা ও উন্নয়নের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। স্থানীয়দের কাছে সেনাবাহিনী মানে শুধু সামরিক প্রহরী নয়, বরং এক অবিচ্ছেদ্য অংশীদার, যারা পাহাড়ের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রযাত্রার অগ্রপথিক।