
সম্পাদকীয়।। রুমাবার্তা।।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকেও দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ অঞ্চলে শত শত বছর ধরে বসবাস করছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী—যাদের রয়েছে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন ও সমাজব্যবস্থা। পাশাপাশি সময়ের পরিক্রমায় এখানেই স্থায়ী হয়েছে বাঙালি জনগোষ্ঠীও, যারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই উন্নয়ন, ব্যবসা, চাকরি বা সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে এখানে এসেছে।
এ দুটি জনগোষ্ঠী বহু বছর ধরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই সহাবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নানা অজুহাতে পাহাড়ে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে, যেন আদিবাসী ও বাঙালিকে মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়। এই ধরনের অপচেষ্টা শুধু পাহাড় নয়, গোটা দেশের জন্যই এক গভীর উদ্বেগের বিষয়।
বিভাজনের পেছনে কারা:
এই প্রশ্নটি আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ে আদিবাসী-বাঙালির মধ্যে দূরত্ব তৈরির পেছনে শুধুই স্থানীয় স্তরের কোনো ক্ষুদ্র সংঘাত দায়ী নয়, বরং অনেক সময়ই এর পেছনে থাকে বৃহৎ স্বার্থের খেলা। কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী, কর্পোরেট স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল কিংবা প্রশাসনিক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সচেতনভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে নিজেরা রাজনৈতিক বা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।
যখন পাহাড়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তখন দেখা যায় একদল লোক সেটিকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়ায়, উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়, আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ আনে কিংবা বাঙালিদের নিরাপত্তাহীনতার গল্প ছড়ায়। আবার কোনো সময় কোনো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর তা পুরো পাহাড়ে ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়।
এই প্রক্রিয়াটি কৌশলী, পেশাদার এবং পরিকল্পিত। কারণ তারা জানে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করতে চাইলে বা স্থানীয় জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আগে তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে হবে।
পাহাড়ের বাস্তবতা ও জাতিসত্তার জটিলতা:
পাহাড়ের সমস্যা কেবল ভূমি বা উন্নয়নকেন্দ্রিক নয়, এখানে জাতিসত্তা, ভাষা, সংস্কৃতি এবং অধিকারের প্রশ্নও জড়িত। আদিবাসীরা বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে, তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ন্যায্যভাবে প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছে না, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি অবহেলিত এবং উন্নয়নের নামে তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, বাঙালিরাও পাহাড়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এই দ্বৈত বাস্তবতা ব্যবহারের সুযোগ নেয় কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। তারা একদিকে আদিবাসীদের অধিকার প্রশ্নে ভিন্ন রকম জাতীয়তাবাদ তুলে ধরে, অন্যদিকে বাঙালিদের ধর্মীয় বা জাতীয় পরিচয়কে সামনে রেখে পাহাড়ে আধিপত্য কায়েমের পক্ষ নেয়। ফলে দুই পক্ষই একে অপরের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। আর এটাই চায় বিভেদের রাজনীতিকরা।
রাষ্ট্রের ভূমিকা ও ব্যর্থতা:
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটি নতুন আশার দ্বার খুলে দিয়েছিল। তবে আজ, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা রয়েছে। ভূমি কমিশন কার্যকর হয়নি, প্রশাসনে স্থানীয়দের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি, নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে, এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক সময় পক্ষপাতমূলক বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। আদিবাসীরা মনে করে, রাষ্ট্র তাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আর রাষ্ট্র অনেক সময় ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র দোহাই দিয়ে আদিবাসী অধিকার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নেয়।
ফলে সমাজে যে বিভাজন তৈরি হয়, তা কেবল সাংস্কৃতিক নয়—রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমেও পুষ্টি পায়। এতে সুবিধা নেয় সেইসব গোষ্ঠী যারা এই নীতিগত দুর্বলতাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।
মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা:
এখানে একটি আশাব্যঞ্জক দিক হলো বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও সুশীল সমাজ এখন পাহাড়ের বিষয়ে আরও সোচ্চার। তারা আদিবাসী ও বাঙালির উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভূমি দখল, জাতিগত বৈষম্য কিংবা গুজব সৃষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবে এটা এখনো যথেষ্ট নয়।
প্রয়োজন স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত সাংবাদিক, যারা পাহাড়ের ভেতর থেকে নিরপেক্ষ তথ্য তুলে আনবে। দরকার সচেতন নাগরিকদের অংশগ্রহণ, যারা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার সেতু গড়ে তুলতে পারবে।
পাহাড়ের আর বিভেদ নয়, সহাবস্থান প্রয়োজন:
পাহাড়ের সমস্যা কোনো ম্যাজিক পদ্ধতিতে সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার ধৈর্য, সংলাপ, ন্যায্যতা ও বাস্তবভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কৌশল। রাষ্ট্রকে অবশ্যই বুঝতে হবে, আদিবাসীরা বাংলাদেশেরই নাগরিক, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-পরিচয় রক্ষা করা শুধু তাদের অধিকার নয়—এটা দেশের বৈচিত্র্য ও মানবাধিকার রক্ষার অংশ। একইভাবে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তাও নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে।
যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে স্থানীয় জনগণের মতামত নিতে হবে, প্রয়োজন সৎ প্রশাসন ও স্বচ্ছতা। ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা ও স্থানীয় নেতৃত্বের অংশগ্রহণ জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, পাহাড়কে দেখতে হবে একটি বৈচিত্র্যময় সম্প্রীতির ভূখণ্ড হিসেবে—যেখানে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে গর্ব করতে পারে, অথচ একইসঙ্গে একটি জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে একত্রে এগিয়ে যেতে পারে।
যারা পাহাড়ে আদিবাসী ও বাঙালির মধ্যে বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা চালায়, তারা আসলে দেশের অগ্রগতির বিরুদ্ধেই কাজ করছে। এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হতে হবে রাষ্ট্রকে, নাগরিক সমাজকে, গণমাধ্যমকে এবং সচেতন পাহাড়বাসীকে। পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়, উন্নয়ন চায়, সম্মান চায়—কিন্তু তা হতে হবে সম্মিলিতভাবে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়।
পাহাড়ের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর। সহাবস্থানের পথে আমরা এগিয়ে যাব, নাকি বিভেদের ফাঁদে পা দেব তা নির্ধারণ করতে হবে এখনই।
