।।কক্সবাজার প্রতিনিধি।।
কক্সবাজারের পেকুয়ায় অপহরণের পর শিক্ষক আরিফ হত্যার ‘মূলহোতা’ পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
শনিবার (১২ অক্টোবর) দিনগত গভীর রাতে র্যাব-১৫ ও র্যাব-৭-এর একটি যৌথ অভিযানিক দল চট্টগ্রাম মহানগরীর সদরঘাট এলাকার পূর্ব মাদারবাড়ীতে বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রবিবার দুপুরে কক্সবাজার র্যাব কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটি জানিয়েছেন র্যাব-১৫’র অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন।
র্যাব-১৫’র অধিনায়ক জানান, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আরিফ অপহরণের শিকার হন।ঘটনার দিন বিকেল ৫টার দিকে পারিবারিক প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হন আরিফ। এরপর আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাড়ি না ফেরায় তার স্ত্রী মেহবুবা আনোয়ার লাইজু তাকে ফোন দেন। কিন্তু আরিফের মোবাইলে রিং হলেও কল রিসিভ হয়নি। পরিবারের লোকজন সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে তার স্ত্রী ওই দিন মাঝরাতে পেকুয়া থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, ওই দিন এশার নামাজের পর স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে শিক্ষক আরিফের পরিবারের জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে শালিসের কথা ছিল। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে আরিফের মোবাইল নম্বর থেকে তার মায়ের মোবাইলে কল আসে। কল রিসিভ করলে অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে (আরিফের মা) জানান, তার ছেলে অপহরণের শিকার হয়েছে। পরে রাত ২টার দিকে পুনরায় কল করে চট্টগ্রাম নগরীর ফ্রিপোর্ট থেকে আরিফকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলেও পরদিন ফ্রিপোর্ট এলাকায় গিয়ে অনেক খুঁজেও আরিফের অবস্থান জানা যায়নি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও আরিফের মোবাইলে কল ঢোকেনি। পরে আরিফের মুক্তির জন্য ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আরিফের স্ত্রীকে সেই টাকা নিয়ে পরদিন বিকেল ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর নতুন ব্রিজ পুলিশ বক্সের সামনে যেতে বলেন অপহরণকারীরা।
এ সময় তারা হুমকি দিয়ে বলে- ‘কোনো চালাকি অথবা পুলিশ, র্যাব কিংবা আর্মির দ্বারস্থ হলে তোর স্বামীর মরদেহ পাবি।’ এ কথা বলার পর মোবাইলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় আরিফের ছোট ভাই বাদী হয়ে পেকুয়া থানায় মামলা করেন।
র্যাব জানায়, গত ১১ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আরিফের নিজ বাড়ির পাশে পুকুর থেকে তার বস্তাবন্দি গলিত হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। র্যাব অধিনায়ক বলেন, মোহাম্মদ আরিফ অপহরণের পর থেকে ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব-১৫। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে র্যাবের যৌথ আভিযানিক দল চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন আন্দরকিল্লা কাঁচাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার অন্যতম হোতা ও আরিফের স্বজনদের কাছে সরাসরি মোবাইলে কল করে মুক্তিপণ দাবি করা রুবেল খানকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়।
রুবেল খান চাঁদপুরের সদর থানার চরপুরচণ্ডী এলাকার হাবিবুল্লাহর ছেলে। তিনি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি বাংলালিংকে চাকরি করার সুবাদে মোবাইল ট্র্যাকিং বিষয়ে অবগত ছিল। এর মধ্যে পেকুয়ায় চাকরির সুবাদে হত্যার শিকার আরিফের বাড়িতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি।
লে. কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই আজমগীর শিক্ষক আরিফকে অপহরণের কয়েক দিন আগে ট্র্যাকিং নিয়ে রুবেলের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকেই মুক্তিপণ আদায়ের পর ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে রুবেলের সঙ্গে জাহাঙ্গীর ও আজমগীরের চুক্তি হয়।
র্যাব দাবি করছে, গ্রেফতার জাহাঙ্গীর আলম-ই শিক্ষক আরিফকে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা। তিনি পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হত্যা, জোরপূর্বক ভূমি দখল, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অগ্নিসংযোগ ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জাহাঙ্গীর এ হত্যাকাণ্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন দাবি করে র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, ৭-৮ বছর ধরে জাহাঙ্গীর ও অধ্যক্ষ আরিফের পরিবারের মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদ ও সম্পর্কের টানাপড়েন চলে আসছিল। জাহাঙ্গীর ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দীর্ঘদিন তার এই দখলদারিতে চুপ ছিলেন আরিফ ও তার পরিবার। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আরিফ নিজেদের জমি ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আইনগত লড়াই শুরু করেন। এ নিয়ে আরিফের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন জাহাঙ্গীর। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার আরিফের সঙ্গে কথা-কাটাকাটিও হয় তার। মূলত এর জেরেই আরিফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন জাহাঙ্গীর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাঙ্গীর, আজমগীর ও রুবেল জাহাঙ্গীরের বাসাসংলগ্ন গোপন স্থানে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেন। মূলত এসব বৈঠকে তারা আরিফকে অপহরণ, হত্যা ও তার স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুবেল মাসখানেক ধরে আরিফের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন। সর্বশেষ ২১ সেপ্টেম্বর শেষবারের মতো তারা বৈঠকে মিলিত হয়ে সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ আরিফ বাসা থেকে বের হওয়া মাত্রই রুবেল তা জাহাঙ্গীর ও আজমগীরকে জানিয়ে দেন।
এরপর প্রথমে আরিফকে তুলে নেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে হত্যা ও বস্তাবন্দি করে পুকুরের পানিতে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়। পরে জাহাঙ্গীরের আদেশে রুবেল খান নিহত আরিফের মোবাইল ব্যবহার করে তার স্বজনদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে শুরু করেন। এসব বিষয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদারক করছে- এমনটি আঁচ করতে পেরে গ্রেফতারকৃতরা আত্মগোপনে চলে যান। পরে গত ১১ অক্টোবর ভোররাতে রুবেল খান ও ১২ অক্টোবর রাতে জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়।