।।বান্দরবান প্রতিনিধি।।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্যঅঞ্চলের সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তির করেছিল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। সেই ঐতিহাসিক চুক্তির ২৭ তম বর্ষপূর্তি আজ। কিন্তু দুইযুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো হয়নি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। ফলে দীর্ঘ দুই যুগ পরও পার্বত্যঞ্চলে এখনো থামেনি রক্তের ঝণঝনানি সংঘাত। তাছাড়া শান্তপ্রিয় জেলা বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ। এই অস্থিতিশীল পরিবেশে আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে দিনপার করতে হচ্ছে এখানকার মানুষদের। ফলে পাহাড়ের মানুষের মাঝে আর্থসামাজিক পরিবর্তন না ঘটায় পিছিয়ে রয়েছে পার্বত্যঞ্চলের জনপদের মানুষ। এই চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে না বলে মনে করছেন পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হলেও মুলধারা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমি কমিশন, স্থানীয় পুলিশ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়াই এখনো আসেনি পাহাড়ের কোন পরিবর্তন। যা কারণে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিনিয়ত ঘটছে।
অন্যদিকে গত ২৫ বছরে কমিশনের কাছে এখন প্রায় ১৬ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়ে আছে। ২০১৬ সালের পর থেকে এই কমিশন আর কোন আবেদনও গ্রহণ করেনি। যার ফলে এখনো পার্বত্যঞ্চলে যুগযুগ ধরে চলছে ভুমি বিরোধ।
ইউনাইটেড পিপল’স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক) বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি উবামং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বিরোধী পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে সংঘাত, রক্তপাত ও হানাহানি কারনে পাহাড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। তাছাড়া ভূমি কমিশন, স্থানীয় পুলিশ, বন ও পরিবেশবিষয়ক ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়াই পার্বত্যঞ্চলে এখনো যুগযুগ ধরে চলছে ভুমি বিরোধ। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান পার্বত্য চট্টগ্রাম যে চুক্তি ধারা গুলো বাস্তবায়ন হয়নি, যথাযথ দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন করা দাবী জানান তিনি।
আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, শান্তি চুক্তি কোনো একক দলীয় সরকারের সাথে বা একক দলের সাথে শান্তি চুক্তি করা হয়নি। খন্দকার মোস্তাক ব্যতিত বঙ্গবন্ধু আমল থেকে পতিত শেখ হাসিনার সরকারের এই পর্যন্ত প্রায় ২৬ বার বৈঠক হয়েছে। বিএনপির আমলে কর্নেল অলির নেতৃত্বে মূল কমিটির সাথে ৬ বার, এরশাদ আমলে ৭ বার, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে উপকমিটির সাথে ৬ রাব ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ৭ বার বৈঠকের পরে শান্তি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তাছাড়া পার্বত্য শান্তি চুক্তি পার্বত্য অঞ্চলের পাশাপাশি গোটা বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এই চুক্তি মানবাধিকার দৃষ্টিতে দেখলে, শুধু মার্মা বা চাকমারা নয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও বাঙ্গালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চুক্তি। এই চুক্তির মধ্যে প্রথাগত অধিকার আছে, বংশপরম্পরায় বসবাসের সামাজিক অধিকার রয়েছে। তাই শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হলে পাহাড়ে থেমে যাবে সংঘাতময়ীসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড।
প্রবীণ শিক্ষক ক্যশৈপ্রু খোকা বলেন, চুক্তির স্বাক্ষরিত হলেও চূড়ান্ত রূপে চুক্তির ভিত্তিক পরিপূর্ণতা লাভ করে নাই। যথাসম্ভব বিশেষ করে বর্তমান সরকার, এলাকার জনগণ এবং রাজনীতিবিদ ও দেশের জনপ্রতিনিধিসহ সকলে ঐক্যমত ভাবে অসম্পূর্ণ চুক্তিকে বাস্তবায়ন করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ বছর পরেও বাস্তবায়ন হয়নি দুই তৃতীয়াংশ ধারা। আদিবাসী জনগোষ্ঠী যাতে নিজেদের স্বতন্ত্র অধিকার, সংঘাত, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার না হয়, সে লক্ষ্যে এই চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তির ২৭ বছর পরেও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্দলের কারণে সংঘাতসহ নানান সময়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত থামেনি। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাছে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে যেমন আশাবাদী, ঠিক তেমনি পাহাড়ে সাধারণ মানুষও আশাবাদী। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করেন সাধারণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ ও পার্বত্য আঞ্চলের নেতারা।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সভাপতি অংচমং মারমা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চুক্তি হয়েছে প্রায় তিন দশক পার হতে চলল। অনেক চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন করার সম্ভব হয়নি। পুরোদমে চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে এই মুহূর্তে যে সংঘাত, হানাহানি, সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ড গুলো হচ্ছে। এখানকার মানুষের শান্তি ফিরাতে পার্বত্য চুক্তি ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএস মং বলেন, শান্তি চুক্তি কোনো একক দলীয় সরকারের সাথে বা একক দলের সাথে শান্তি চুক্তি করি নাই। খন্দকার মোস্তাক ব্যতিত বঙ্গবন্ধু আমল থেকে পতিত শেখ হাসিনার সরকার পর্যন্ত ২৬ বার বৈঠক হয়েছে।এই চুক্তি সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জনগণের পক্ষ থেকে অঙ্গিকার করেছে। স্বাধীন সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আনুগত্য, আস্থা ও বিশ্বাস বজায় থাকবে। এবং এই চুক্তির মধ্যে পাহাড়িদের পাশাপাশি ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাসরত অবহেলিত বাঙ্গালীদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।