ম্রো সম্প্রদায়ের ক্রামাদি ধর্ম ও বর্ণমালা উদ্ভাবক মেনলে ম্রো

0
7

।।আকাশ মারমা মংসিং বান্দরবান।।

বান্দরবানের পাহাড় বিস্তৃত চিম্বুক পাহাড়। এই সড়কের পাহাড় কোলে ঘেষে বসবাস করছেন কয়েক হাজারো ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন। যাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণমালা ও সামাজিক রীতিনীতি। মেঘছোঁয়া এই পাহাড়ের ক্রামাদিপাড়ায় তৈরি হয়েছে একটি অন্য রকম স্থাপনা। নাম বর্ণমালার ঘর। এই বর্ণমালার ঘর ম্রো সম্প্রদায়ের। ঘরের ভেতরে সাজানো রয়েছে ম্রো বর্ণমালা। ভাষাটি যাতে হারিয়ে না যায়, যেন বাসিন্দারা এসে তাদের মুখের ভাষার লিখিত রূপটি শিখতে পারেন, সে জন্য এই উদ্যেগ গ্রহন করেছেন তারা।গতকাল ছিল ম্রো বর্ণমালার আত্মপ্রকাশের দিন। দিনটি স্মরণীয় করে রেখে ম্রো ভাষা ও ক্রামা ধর্মের (ম্রো জনগোষ্ঠীর ধর্ম) প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বর্ণমালা ঘর করা হয়েছে। এই ক্রামাদি ধর্ম ও ম্রো ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছিলেন মেনলে ম্রো নামে এক যুবক। গতকাল বর্ণমালা ঘরটি উদ্বোধন করেন ক্রামা ধর্মের প্রধান পুরোহিত মাংইয়া ম্রো।

মেনলে ম্রো ছোটকালে সুয়ালক ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেনীর পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বাংলার পড়ালেখা পাশাপাশি তিনি নিজের ম্রো সম্প্রদায়ের প্রতি চিন্তামগ্ন ছিলেন। নিজেদের সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখতে নিজের পরিবারকে ত্যাগ করে সবুজ বনবেষ্টিত মনোরম পাহাড়ের একটি পাথরে বসে ধর্মীয় গুরু মেনলে ম্রো ‘ক্রামা ধর্ম’ প্রবর্তনের আগে ধ্যান করেছিলেন। ওই ধ্যানের পাথরের পাশে একটি পাকুড় ও বটগাছ রয়েছে। ১৯৮২ সালে নিজের জ্ঞান ও মেধাশক্তি ব্যবহার করে ক্রামাদি বর্ণমালা উদ্ভাবন করেন। পরে বর্ণমালা থেকে ক্রামাদি ধর্ম হিসেবে রুপান্তরিত হয়। এরপর তিনি পায়ে হেটে প্রতিটি ম্রো গ্রামে গ্রামে ধর্ম প্রচার করে নিরুদ্দেশের চলে যান। আবার ফিরিয়ে আসবেন বলে নিজের জাতিসত্তাকে এমটা আশা দিয়ে গেছেন ম্রো সম্প্রদায়ের ক্রামাদি ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো।

বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোল ঘেষে গড়ে উঠেছে ম্রো সম্প্রদায়ের ক্রামাদি পাড়া গ্রাম। এই গ্রামের বসতির সংখ্যা প্রায় আড়াইশত মানুষের বসবাস। ম্রো জাতিসত্তাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য পোশাক-আশাক থাকলেও ছিল না নিজেদের বর্ণমালা ও ধর্ম। কিন্তু ১৯৮২ সালে ম্রো সম্প্রদায়ের মেনলে ম্রো নামে এক যুবক ক্রামাদি ধর্ম ও বর্ণ আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এরপর থেকে ক্রামাদির বর্ণমালা ও ধর্ম হিসেবে ধারণ করে পথচলা শুরু হয় ম্রো সম্প্রদায়ের। বর্ণমালা সাথে ধর্ম একই সূত্রে গাথা রয়েছে। ম্রো সম্প্রদায়ের বিশ্বাস করেন তাদেরও একটি ধর্ম আছে সেটি নাম ক্রামাদি ধর্ম।

ক্রামাদি ধর্ম ও বর্ণ আত্মপ্রকাশের পর থেকে ৪০ বছর ধরে রীতিনীতি আচার ও প্রথা পালন করে আসছে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। এই দিনে ক্রামাদি ধর্ম আত্মপ্রকাশ হয়েছিলে বলে স্বরণীয় দিনটিকে ম্রো জনগোষ্ঠীর ক্রামা ধর্মের ৪০তম বার্ষিক ধর্মীয় সম্মেলনও গতকালই শুরু হয়েছে। দুদিনের এই সম্মেলনের শুরুতে বর্ণমালা ঘর উদ্বোধন করা হয়। ম্রো বর্ণমালা বা হরফ অনেকটা রোমান ধাঁচের। এতে কিছুটা বর্মি ও মোনখেমার বর্ণমালার সংমিশ্রণ রয়েছে। এই দিনটিকে ঘিরে নিজেদের ভাষা ও বর্ণমালার টানে শত শত ম্রো ভাষার নারী-পুরুষ দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন হাজারো মানুষ।

ক্রামাদিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়া থেকে প্রায় ২০০ মিটার দক্ষিণে আধা পাকা ছোট্ট বর্ণমালা ঘর। বটগাছের ছায়ায় ঘেরা বর্ণমালার ঘরে সারি সারি ম্রো বর্ণমালা সাজানো। একটি কাঠের বইয়ে কয়েকটি হরফ খোদাই করা হয়েছে। প্রকৃতি–ঘনিষ্ঠ সরল জীবনের ম্রোদের বর্ণমালা ঘরটির আয়োজনও সরল প্রকৃতির মতোই অনাড়ম্বর। ক্রামাদিপাড়ায় ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে ক্রামাদি (ধর্মীয় গুরু) মেনলে ম্রো বর্ণমালার আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য ডিসেম্বরে বর্ণমালা ঘর স্থাপন করা হয়েছে। ঘরটির নাম দেওয়া হয়েছে থারকিম। যার অর্থ ফুলের কলি থেকে ফোটা ফুল।

বর্ণমালা উদ্ভাবক মেনলে ম্রোর ভাই কিরওয়ান ম্রো জানালেন, মোট ৩১টি হরফের মধ্যে ছয়টি স্বরবর্ণ। রোমান বর্ণমালার বড় ও ছোট হাতের বর্ণের মতো ম্রো বর্ণমালায়ও সাংলু, ইউকলুং ও মুক্লুং—তিন ধরনের বর্ণ রয়েছে। আবার ধর্মের জন্য শুধু ইউক্লুং বর্ণ ব্যবহার করা হয়।

ম্রো সমাজের শিক্ষিত পাকো ম্রো জানালেন, ১৯৮২ সাল প্রবর্তিত এই নতুন ধর্ম ভাষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ম্রো সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ম্রো নবীনতম এই ক্রামা ধর্মের অনুসারী এবং প্রায় ৮০ শতাংশ ম্রো এই বর্ণমালায় লেখতে-পড়তে পারেন। ২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ম্রোদের জনসংখ্যা ৫১ হাজার ৪৪৮। ম্রোরা শুধু বান্দরবান পার্বত্য জেলার সাতটি উপজেলায় বসবাস করে।

ক্রামা ধর্মের প্রধান পুরোহিত মাংইয়া ম্রো বললেন, মূলত ক্রামাদি মেনলে ক্রামা ধর্মের ধর্মীয় বিধিবিধান সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ক্রামা বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছিলেন। ধর্মীয় বর্ণমালাটি এখন ম্রো বর্ণমালা হয়েছে। এই বর্ণমালার উন্নয়ন ও ব্যবহারিক ক্ষেত্র বাড়াতে বর্ণমালা ঘর ভূমিকা রাখবে। এটি সামাজিক উদ্যোগ এবং ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছে। তবে তাদের ভাষা উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা সবচেয়ে জরুরি।

ম্রো বর্ণমালা উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কমিটি সিইং পাট ম্রো বলেন, ১৯৮২ সালে ক্রামাদি মেনলে ম্রো দুটি ধর্ম ও বর্ণমালা দিয়ে গেছেন। আর ধর্মে দিক দিয়ে তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণভাবে স্পষ্ট বলে গেছেন,”টা আন (বিনয়ী), পইঞা (আদর্শ) ও প্রেংঞা ( বুদ্ধি)। এই তিনটি জ্ঞান অর্জন করতে হলে বর্ণমালা জানার প্রয়োজন। তাছাড়া ম্রো সম্প্রদায়ের এই ক্রামাদি বর্ণমালা টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন’ তা না হলে বিলুপ্তি হয়ে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here