খেলার ডেক্স।।
ইতিহাসের হাতছানি, আনহেল দি মারিয়ার বিদায়কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোপা আমেরিকার ফাইনাল ঘিরে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের আবেগের পারদ ম্যাচের আগে থেকেই চড়ে ছিল। সেই আবেগ যেন শতধারায় উৎসারিত হতে শুরু করে চোট পেয়ে লিওনেল মেসিকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হলে। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে কেঁদেছেন মেসি। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক কেঁদেছেন ডাগআউটে বসেও।
টেলিভিশনের পর্দায় মেসির কান্নার দৃশ্য দেখতে দেখতেই ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়েছে গোলশূন্য অবস্থায়, ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে বদলি হিসেবে নামা লাওতারো মার্তিনেজের ১১২ মিনিটের গোলে চরম আবেগের ম্যাচে কলম্বিয়াকে ১–০ ব্যবধানে হারিয়ে কোপা আমেরিকার রেকর্ড ১৬তম শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। এর আগে ১৫টি শিরোপা জিতে উরুগুয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কোপা আমেরিকার সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের রেকর্ডে নাম ছিল তাদের।
এই জয়ে একটি ত্রিমুকুটও পেয়ে গেলেন মেসি–দি মারিয়ারা। মহাদেশীয় শিরোপা, বিশ্বকাপ, আবার মহাদেশীয় শিরোপা-স্পেনের পর এই ত্রিমুকুট জেতা দ্বিতীয় দল এখন আর্জেন্টিনা। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার পর ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা জিতল ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা। স্পেন এই কীর্তি গড়েছিল ২০১০ বিশ্বকাপের আগে ও পরে ইউরোর শিরোপা জিতে। ইউরোর শিরোপা দুটি তারা জিতেছে ২০০৮ ও ২০১২ সালে।
আর্জেন্টাইনদের আবেগের ম্যাচটি দর্শক–বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায় ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট দেরিতে হয়। বিনা টিকিটে খেলা দেখতে আসা কিছু দর্শক নিরাপত্তর বেড়াজাল এগিয়ে মাঠে ঢোকার চেষ্টা করে। সেটা সামলাতে সময় লাগায়ই ম্যাচ শুরু করতে এই দেরি।
দেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচে প্রথম আক্রমণটা করেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু এরপর থেকেই ম্যাচে শুরু হয় কলম্বিয়ার আধিপত্য। পুরো প্রথমার্ধেই আর্জেন্টিনার ওপরে ছড়ি ঘুরিয়েছেন হামেস রদ্রিগেজ-লুইস দিয়াজরা। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার চেয়ে সবদিক থেকেই এগিয়ে ছিল কলম্বিয়া। প্রথমার্ধ শেষে কলম্বিয়ার বলের দখল ছিল ৫৩ শতাংশ, আর্জেন্টিনার ৪৭ শতাংশ। কলম্বিয়া গোলে শট নিয়ে লক্ষ্যে রেখেছে ৪টি, আর্জেন্টিনা ১টি। কলম্বিয়ার মোট পাস ২৫৭টি, আর্জেন্টিনা ২৩২টি। নিখুঁত পাসেও এগিয়ে ছিল কলম্বিয়া-৯০ শতাংশ, আর্জেন্টিনা ৮৭ শতাংশ।
প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনাকে কোণঠাসা করে রাখা কলম্বিয়া ম্যাচে প্রথম সুযোগ পায় ৫ মিনিটে। বাঁ প্রান্ত দিয়ে বক্সের বাইরে থেকে লুইস দিয়াজের গড়ানো শট এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সহজেই গ্লাভসে নেন। পরের মিনিটেই ডান প্রান্ত থেকে হামেস রদ্রিগেজের ছোট ক্রস থেকে বক্সের মধ্য থেকে ভলি করেন করদোবা, কিন্তু বল দূরের পোস্টে লেগে চলে যায় বাইরে। ১১ মিনিটে ম্যাচের দ্বিতীয় ও কলম্বিয়ার প্রথম কর্নার। ১২ মিনিটে রদ্রিগেজের কর্নার থেকে প্রথমে হেড করে বল বক্সের ঠিক মাঝে দেন দিয়াজ। সেখান থেকে করদোবার হেড গোললাইন থেকে ঠেকান মার্তিনেজ।
ম্যাচ ১০ মিনিট পেরোনোর পর পজিশন বদলে বাঁ উইংয়ে চলে যান দি মারিয়া। এরপর বাড়ে আর্জেন্টিনার আক্রমণের গতি। দি মারিয়া জায়গা বদলের পর কিছুক্ষণ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল আর্জেন্টিনার কাছে। সেই সময়ই প্রথমার্ধে লক্ষ্যে রাখতে পারা একমাত্র শটটি নেন মেসি। ১৯ মিনিটে দি মারিয়ার দুর্দান্ত এক নিচু ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে বল পান আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। প্রথম স্পর্শটাই ছিল গোলমুখী তীব্র গতির শট। কিন্তু আর্জেন্টিনারই এক খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে বলের গতি কমে যায়। কলম্বিয়ার গোলকিপার ভারহাস সহজেই বল গ্লাভসে নেন।
আর্জেন্টিনার মিনিট বিশেকের আধিপত্যের পর আবার ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় কলম্বিয়া। ৩২ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে কলম্বিয়ার লেমার বুলেট গতির শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে হাতে লাগিয়ে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন মার্তিনেজ। ২৬ মিনিটে হালকা চোট পান মেসি। ক্রস করতে গিয়ে তাঁর পায়ে পা লাগে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডারের। মাঠের বাইরেও চলে যেতে হয়েছিল। তবে একটু পরই মাঠে ফেরেন তিনি। ৪২ মিনিটে বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা। মেসির ফ্রি-কিক থেকে তালিয়াফিকোর হেড চলে যায় বারের ওপর দিয়ে।
৪৮ মিনিটে বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে আসা মেসির পাস আরেকজনের পা হয়ে ফাঁকায় এসে বক্সের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তালিয়াফিকো শট নেওয়ার আগেই সেটা কলম্বিয়ার গোলকিপার স্লাইড করে দূরে পাঠান। বল পেয়ে যান দি মারিয়া। তাঁর নেওয়া শট দ্রুত জায়গায় এসে ফিরিয়ে দেন গোলকিপার। ৫৬ মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে ম্যাক অ্যালিস্টারের হেড ঠেকিয়ে কলম্বিয়ার এক খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসে। সেখান থেকে বল পেয়ে যান মেসি। তিনি আবার বল পাঠান বক্সে। কিন্তু এবার আর বল পাননি আর্জেন্টিনার কেউ। ৫৭ মিনিটে আবার দি মারিয়া বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পাস দেওয়ার ভান করে গোলে শট নেন। সেটি কর্নারের বিনিময়ে কোনোমতে রক্ষা করেন গোলকিপার।
৬৩ মিনিটে দিয়াজের কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে গিয়ে পেশিতে টান লাগে মেসির। মাঠে পড়ে যান তিনি। মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার কিছুক্ষণ পর বাইরে চলে যান আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। তাঁর জায়গায় আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি মাঠে নামান নিকোলাস গঞ্জালেসকে। মাঠ ছাড়ার সময় হতাশায় বারবার মুখ ঢাকছিলেন মেসি। গ্যালারিতে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের চোখেমুখেও ছিল একই রকম হতাশা। একটু পর মেসি ডাগআউটে বসে কেঁদেওছেন।
পরের মিনিটেই করদোবার ট্যাকলে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান গঞ্জালো মনতিয়েল, তাঁর জায়গায় মাঠে নামেন নাহুয়েল মলিনা। এরপরই দারুণ এক সুযোগ পেয়ে যায় কলম্বিয়া। কিন্তু সেটি কাজে লাগাতে পারেনি তারা। উল্টো করদোবা ফাউল করেন ম্যাক অ্যালিস্টারকে। কিন্তু পায়ে ব্যথা পান করদোবাও। এ কারণে সম্ভাব্য পেনাল্টি চেক করেন রেফারি। পরে অবশ্য আর্জেন্টিনাকেই ফাউল দেন রেফারি।
সেই ফ্রিক-কিক থেকে কলম্বিয়ার বক্সের ঠিক বাইরে বল পেয়ে যান দি মারিয়া। তিনি বক্সের মধ্যে বল বাড়ান তালিয়াফিকোকে। তিনি বল দেন নিকো গঞ্জালেসকে, বল তিনি জালেও জড়ান। কিন্তু এর আগেই সহকারি রেফারি অফসাইডের জন্য পতাকা তোলেন। পরে ভিএআরেও দেখা গেছে তালিয়াফিকো ছিলেন অফসাইডে। এর পরের মিনিটেই নিকো গঞ্জালেসের শট পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে বল চলে যায়।
এরপর আরও দুটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ৮৭ মিনিটে বক্সের মধ্যে গোলকিপারকে একা পেয়ে গোল করতে পারেননি দি মারিয়া। আর যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে পারলেই গোল পেতেন নিকো গঞ্জালেস। কিন্তু তিনি পারেননি। ম্যাচ শেষ পর্যন্ত গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
শুরু হওয়া আর্জেন্টিনা–কলম্বিয়া ফাইনালের নির্ধারিত ৯০ মিনিটেও ছিল নানা নাটকীয় ঘটনা। চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেছেন লিওনেল মেসি। কেঁদেছেন ডাগআউটে বসে। এরপর নিকো গঞ্জালেসের গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হওয়ায় হতাশা আরও বেড়েছিল আর্জেন্টিনা দলে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা থাকে গোলশূন্য। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো আনহেল দি মারিয়ার বিদায়ী ম্যাচে লাওতারো মার্তিনেজের ১১২ মিনিটের গোলে ত্রিমুকুট জিতেছে আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনার অধিনায়কের জায়গায় মাঠে নামা নিকো গঞ্জালেস বল জালে জড়ালেও অফসাইডের কারণে গোল বাতিল করেন রেফারি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকা ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে ৯৪ মিনিটে রদ্রিগো দি পলের ক্রসে শট না নিয়ে ডামি করেন দি মারিয়া। বল পেয়ে যান তাঁর পেছনে থাকা নিকো গঞ্জালেস, গোললাইন থেকে সেটি বাঁচিয়েছেন ভারহাস। ১০১ মিনিটে আবার দুর্দান্ত এক আক্রমণ থেকে গোল পায়নি কলম্বিয়া। ১০৭ মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে পা লাগাতে পারলেই গোল পেতেন হুয়ান আলভারেজের জায়গায় ৯৭ মিনিটে মাঠে নামা লাওতারো মার্তিনেজ। কিন্তু তিনি তা পারেননি।
১১২ মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে রদ্রিগো দি পলের পাস মাঝমাঠে খুঁজে নেয় জিওভান্নি লো সেলসোকে । তিনি বল বাড়ান ডান প্রান্তে বক্সের কাছাকাছি থাকা মার্তিনেজকে। ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়ান ইন্টার মিলানের ফরোয়ার্ড। এ নিয়ে এবারের কোপা আমেরিকায় তাঁর গোল হলো ৫টি। সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটা উঠছে তাঁরই হাতে। মেসি মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার পর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেতৃত্ব পেয়েছিলেন দি মারিয়া। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার তাঁকে তুলে কোচ লিওনেল স্কালোনি মাঠে নামান ডিফেন্ডার নিকোলাস ওতামেন্দিকে।
দি মারিয়া মাঠ থেকে নেমে ডাগআউটে গিয়ে কান্নাভেজা চোখে জড়িয়ে ধরেন মেসিকে। মেসিও কাঁদলেন দি মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে। ১৬ বছরের সতীর্থকে বিদায় দেওয়ার কষ্টের সঙ্গে মেসির এবারের কান্নায় মিশে ছিল কিছুক্ষণ পরই কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে যাওয়ার আনন্দও।
মেসি–দি মারিয়ারা আনন্দ–বেদনার কান্না যখন মাখামাখি, মাঠে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল উত্তেজনা। পিছিয়ে পড় কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না সম্ভাব্য হার। একটা পর্যায়ে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন তারা। রেফারি মধ্যস্থতায় থামে সে মারামারি। এরপর…? মেসি–দি মারিয়াদের ইতিহাস, আর্জেন্টাইনদের আনন্দে মেতে ওঠা!