নিজস্ব প্রতিবেদক।।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কমিশনের কেউ কেউ বিলম্ব না করে সরাসরি মামলার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে দুদক কর্মকর্তাদের কেউ বলছেন, মামলার মেরিট ঠিক রাখতে হলে আগে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করতে হবে। তা না করে সরাসরি মামলা হলে আদালতে আইনি সুবিধা নিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন বেনজীর।
এদিকে সময় বাড়িয়ে দুদকের তলবে হাজির না হয়ে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তান আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব পাঠানোর বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশে অবস্থান নিশ্চিত করার পর কোনো ব্যক্তি আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাবে বিদেশ থেকে পাঠানো এ ধরনের জবাব গ্রহণের কোনো নজির নেই। তবে বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তলবের জবাব দিতে পারেন। বেনজীর পরিবার সেই সুযোগ নেয়নি। এই সুযোগ নিতে দ্বিতীয় দফায় সময়ের আবেদনও করেনি। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘আইনজীবীর মাধ্যমে বেনজীর একটি লিখিত জবাব দিয়েছেন। সেই বক্তব্যে উপস্থিতির ব্যাপারে কিছু লেখেননি। সেখানে তার ও পরিবারের সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা না আসায় আইন ও বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সশরীরে উপস্থিত না হয়ে বিদেশ থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো বক্তব্য গ্রহণ করার সুযোগ আছে কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অনুসন্ধান টিমের এখতিয়ার। তারা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করছেন। তার বক্তব্য গ্রহণ করা যাবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেবে অনুসন্ধান টিম। টিমের সুপারিশ অনুযায়ী কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাকে দেওয়া বর্ধিত সময়ও পেরিয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে অনুসন্ধান দলের মতামতের ভিত্তিতে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবেন।
বেনজীরের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে যুগান্তর থেকে যোগাযোগ করা হয়, পরে রুমা বার্তা ডটকমকে যুগান্তর নিজস্ব প্রতিবেদক মুঠোফোনে জানান। এতে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে দুদক যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, তখনই আমাদের এবং দেশবাসীর মনেও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। প্রশ্নটা ছিল এমন, যিনি পুলিশ ও র্যাবের প্রধান ছিলেন, রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী, তাকে কি বাস্তবেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। নাকি কোনো ধরনের সমঝোতার অংশ হিসাবে এটা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার শুরুতে তার বিরুদ্ধে যে তৎপরতা দেখানো হয়েছিল, ক্রমাগত তা স্তিমিত হয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই তার দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। কাজেই পুরো বিষয়টা এক ধরনের ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান-এ কথা মাথায় রেখে কোনো দিক থেকে প্রভাবিত না হয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে এ প্রত্যাশা সব সময়ই কঠিন ছিল। এখনো কঠিন রয়ে গেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে যে গতিতে বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল তা অনেকটাই এখন স্তিমিত। দুদকের কার্যক্রমে নানা প্রক্রিয়ায় বেনজীরকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার মানসিকতা প্রকাশ পাচ্ছে। সশরীরে উপস্থিত না হয়ে দেশ থেকেও কেউ বক্তব্য পাঠালে সাধারণত তা রিসিভ করা হয় না। আনুষ্ঠানিকভাবে জবাব পাওয়ার কথা সাংবাদিকের সামনে তুলে ধরাও হয় না। কিন্তু বেনজীরের ক্ষেত্রে আলাদা নজির সৃষ্টি হচ্ছে। কমিশনের তরফ থেকে আগ বাড়িয়ে বলা হয়েছে, তিনি সময় চাইলে ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আবার আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব পাঠানোর পর সই ও ওকালতনামা যাচাই-বাছাইয়ের আগেই বলা হয়েছে-জবাব পাওয়া গেছে। বেনজীর যে বিদেশ গেছেন এটাও যাচাই করা হচ্ছে না। অন্যদের ক্ষেত্রে বিদেশ যাওয়ার প্রশ্ন উঠলে দুদক যাচাই করে। অথচ বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তান এখন কোথায় অবস্থান করছেন তা দুদকের পক্ষে উদ্ধার করা একেবারেই সহজ। অনুসন্ধান দলের পক্ষ থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হতে ইমিগ্রেশন পুলিশ কিংবা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছেও কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি। দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বেনজীরের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া অনুসন্ধান দলের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। তার অবস্থান জানার বিষয়ে অনুসন্ধান দলের এই নিষ্ক্রিয়তা হয়তো তাদের কৌশল।
আরও জানা গেছে, ২৮ মে বেনজীরের পক্ষে করা সময় বাড়ানোর আবেদনে বলা হয়, ‘৬ জুন কমিশন দপ্তরে আমাকে তলব করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি সপরিবারে চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। তাছাড়া বক্তব্য প্রদানের জন্য কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, রেকর্ড ও নথিপত্র খোঁজ করে জোগাড় করা দরকার। দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর চাকরি জীবনে বিভিন্ন স্থানে বদলি হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট আয়কর অফিস এবং হিসাবরক্ষণকারী অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া আমি দীর্ঘ তিন বছরের অধিককাল বসনিয়া ও কসোভো শান্তিরক্ষা মিশনে এবং সর্বশেষ জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সদর দপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলাম। উল্লিখিত কর্মস্থলসমূহের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জোগাড় করাও সময়সাপেক্ষ। এজন্য তার দুই মাস সময় প্রয়োজন।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেনজীরের এই চিঠির তথ্য স্পষ্ট করে তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জবাব না পাঠিয়ে তিনি প্রচলিত নিয়ম ভেঙে আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব পাঠিয়েছেন। এরপরও কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দুদকের পক্ষ থেকে তলবের জবাব পাওয়ার কথা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য কারও ক্ষেত্রে এমন কোনো নজির নেই। একইভাবে সময় বাড়িয়ে নিয়ে সোমবার দুদকে হাজির হননি বেনজীরের স্ত্রী ও দুই কন্যা। তারাও আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব পাঠিয়েছেন।
জানা গেছে, বেনজীর যাতে আদালতে আইনি ‘বেনিফিট’ নিতে পারেন এজন্য কৌশলী অবস্থানে হাঁটছে দুদকের কেউ কেউ। সময়ক্ষেপণ না করে কমিশনের এসব কর্মকর্তা দ্রুত সরাসরি মামলা দায়েরের পক্ষে মত দিচ্ছেন। কিন্তু প্রাথমিক অনুসন্ধানে কারও অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলে দুদক আইনের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারির বিধান রয়েছে। সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দেয় কিংবা তথ্য গোপন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ২৬(২) অনুযায়ী মামলা করা হয়। এই মামলার মেরিট শক্ত হয়। আর সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি না করে সরাসরি কারও বিরুদ্ধে ২৭(১) ধারায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলের মামলা করলে তিনি আদালতে আইনি সুবিধা পান। বেনজীরের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করলে তিনি আদালতে বলতে পারেন, দুদক তার সম্পদ বিবরণী চাইলে আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ সম্পদের তথ্য দাখিল করতেন। তার সম্পদ যে বৈধ আয়ে কেনা সেটা তিনি প্রমাণ করতে পারতেন। কিন্তু দুদক তাকে সেই সুযোগ না দেওয়ায় তিনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তখন আদালতের রায় বেনজীরের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
জানা গেছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেনজীর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হয় দুদক। এরপর গত ২৩ ও ২৬ মে দুদকের আবেদন আমলে নিয়ে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের (ক্রোক) নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। গত ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, সাভারের একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরের ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে। এর আগে ২৩ মে ৮৩টি দলিলে ক্রয়কৃত সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। সেই সঙ্গে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাশিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান টিম অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী ও জয়নাল আবেদীন।