আকাশ মারমা মংসিং।।বান্দরবান।।
পাহাড়ের প্রত্যান্তঞ্চলে হারাতে বসেছে রেংমিটচ্যা নামে একটি ভাষা। প্রায় তিনশত শতাব্দীর আগে এই রেংমিটচ্যা ভাষা জানার মানুষগুলো বসবাস করতেন বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন এর নাম ‘রেংমিটচ্য’। বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে এই ভাষা জানা জীবিত মানুষ দু’জন নারী ও পাচজন পুরুষসহ মাত্র সাতজন। এই মানুষগুলো মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে রেংমিটচ্য ভাষাটি! কিন্তু রেংমিটচ্য ভাষাটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা মিলেছে। এই সাতজনের জানা থাকা ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা বাঁচাতে সিংরাও ম্রো নামে এক তরুণ লড়াই করছে। নিজেদের মাতৃভাষাকে বাঁচাতে যে চালিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম সেটি এখন আলোতে ফুটে উঠেছে। সেই প্রত্যান্ত এলাকার গ্রামে গ্রামে এখন শোনা যাবে রেংমিটচ্যা ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও। ভেসে আসবে জাতীয় সংঙ্গীতের সুর শিক্ষার আলোর ফুটবে দুর্গম এলাকার জাতিগোষ্ঠির কোমলমতি শিশুদের মাঝে।
বান্দরবান আলীকদম সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যান্তঞ্চলের তৈন খালের অবস্থিত ক্রাংসিং পাড়ার গ্রামটি। ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দের নৌপথ ধরে যেতে সময় লাগে প্রায় আধা ঘন্টা। এরপর তৈন খালের ঝিড়ি পথ বেয়ে হেটে যেতে সময় লাগে আরো দুই ঘন্টা। আড়াই ঘন্টার পর দেখা মিলে রেংমিটচ্যা ভাষা গ্রাম ক্রাংসি পাড়া। এই গ্রামে বসবাস করে প্রায় ২৭টি পরিবার। তবে রেংমিটচ্যা ভাষা জানা পরিবারের সংখ্যা মাত্র তিন পরিবার। রেংমিটচ্যা ভাষা কথা বলেন মাত্র পাচজন। আরো দুইজন নাইক্ষ্যংড়িতে বসবাস করেন। ২০১৪ সালে এই রেংমিটচ্যা ভাষাটি জানা ছিল ৩২ জন। বাকিরা মারা যাওয়ার পর ২০২৪ সালে তা কমে মাত্র সাতজন হয়েছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের সবার বয়স গড়ে ৬০ বছরের ওপরে। নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া বলতে পারেন নাহ বাংলা ভাষা। সবাই জুমের উপর নির্ভরশীল। ভাষাটি বাচাতে ওই গ্রামে প্রতিদিন সন্ধায় হলে শিশুদেরকে রেংমিটচ্যা ভাষা পড়াতেন রেংমিটচ্যভাষী মাংপুন ম্রোর ছেলে সিংরাও ম্রো। কিন্তু তাতেই থমকে গেছিল ভাষাটি। তারা মারা গেলে মানব সভ্যতা থেকে একটি ভাষার পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবে ভাষাটির সরক্ষণ করতে সেনাবাহিনী থেকে স্কুলস নির্মাণের পর ভাষাটি আলোর মুখ ফুঠেছে সেসব জাতিগোষ্ঠিদের মাঝে।
ক্রাসিং পাড়া বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রত্যান্ত দুর্গম এলাকা হওয়াতেই গ্রামে কোন শিক্ষার আলো ফুটেনি। তার মাঝে নিজেদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্যাও বিলুপ্তির পথে। গ্রামে শিশুদের মাঝে কোন শিক্ষার আলো না পড়াতে সবকিছু থেকে বঞ্চিত। নিজের ভাষা ছাড়া বাংলার ভাষা বলতে পারেন নাহ কেউ। তবে এসব গ্রামে সেনাবাহিনী উদ্যেগে ‘ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামের একটি রেংমিচ্যা ভাষার স্কুল নির্মাণ করাতে গ্রামবাসীদের স্বস্তি ফিরেছে। এতে যেমন নতুন প্রজন্মের শিশুরা রেংমিটচ্য ভাষা জ্ঞান অর্জনে করবে তেমনি ভাষাটির বিলুপ্তির হওয়ার পথ থেকে রক্ষা পাবে বলে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন তারা। তাছাড়া পাহাড়ের যে কয়টি মাতৃভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে সেগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রামের সচেতনব্যক্তি কিংবা সকলকে সমন্নিত উদ্যেগ দরকার বলে মনে করেন ক্রাংসি পাড়া বাসিন্দারা।
এদিকে গতকাল রবিবার বেলা বারোটার দিকে আলীকদম প্রত্যান্তঞ্চলের তৈন খালের অবস্থিত ক্রাংসিং পাড়ার গ্রামে পাহাড়ে চূড়ায় সেনাবিহিনী উদ্যেগে নির্মাণ করা ‘ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ উদ্বোধন করেন ৬৯ পদাতিক রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ। উদ্বোধন শেষে বিদ্যালয় পরিদর্শনের পর বিদ্যালয়ে আঙ্গিনায় গাছ রোপন করেন। এরপর কোমলমতী শিশুদের মাঝে ব্যাগ, সংগীতের সরঞ্জাম ও ক্রাংসি পাড়াতে দরিদ্র-পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। উদ্বোধনে অংশ নেন বান্দরবান নবাগত রিজিয়ন কমান্ডার মেহেদী হাসান, আলীকদম জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোঃ শওকাতুল মোনায়েম পিএসসি, আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কন্দকার তবিদুর রহমানসহ ক্রাংসি পাড়া পাড়াবাসীন্দারা।
নবনির্মিত ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিংরাও ম্রো বলেন, আমাদের রেংমিটচ্য ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে এতদিন নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। পাড়াবাসী ও রেংমিটচ্য ভাষাভাষীর পরিবারের স্কুল নির্মাণে ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতা কারণে নির্মাণ করতে পারিনি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে স্কুল নির্মাণ হয়েছে। এই স্কুলের মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিখাতে পারবো।
প্রধান শিক্ষক সিংরাও ম্রো বলেন, এই স্কুলে রেংমিটচ্য ভাষার পাঠ নিতে আসেন ৩৫ জন কোমলমতি শিশুরা। তার মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষক তিনজন ও রেংমিটচ্যা ভাষা শিক্ষক আমিসহ চারজন আছি। রেংমিটচ্যা ভাষা পাশপাশি বাংলা ভাষাও শেখানো হবে। বলেন, যতদিন বেচে আছি ততদিন রেংমিটচ্যা ভাষাটি সরক্ষণ করে যাবো হারাতে দিবো নাহ।
ম্রো ভাষা লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বললেন, “চোখের সামনে একটা ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে এটা মানতে পারিনি। তাই ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ‘মিটচ্যতখক’ এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, খাদ্য, খেলাধুলা, সংখ্যা, দিন ও মাসের নাম রাখা হয়েছে। রেংমিটচ্য ভাষার বাক্যও আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবাইকে এগুলো শেখানো হচ্ছে।
উদ্বোধন শেষে ৬৯ পদাতিক রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচ্য ভাষা সম্পর্কে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। বান্দরবানে শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সহায়তা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।