
উচ্চপ্রু মারমা।।রাজস্থলী।।
উক্যছাই মারমা সহপাঠীরা চিনেন এরিকশন নামে। ১২ বছরের এই কিশোর গত সোমবার উত্তরায় প্রশিক্ষণ বিমান বিধস্ত ঘটনায় দ্বগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজী বিভাগে সপ্তম শ্রেনীর শিক্ষার্থীর অধ্যায়রত ছিলেন। বিমান বিধস্ত সময় দাঁড়িয়েছিলেন ক্লাসের বারান্দায়। হঠাৎ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। তার শরীরে তখন কিছুটা অংশ আগুনে পুড়েছিল। আগুনে পোড়া নিয়ে বন্ধুদের বাচাঁতে গিয়ে শতভাগ আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে পরেন উক্যছাই মারমা। আগুনের দ্বগ্ধ অবস্থায় তার শিক্ষককে বলেছিলেন আমার হাতে বাবা নাম্বার লিখে দেন। আমার দেহটি যেন সনাক্ত করতে পারে। আমার এই ঘটনাটি শুনে বাবা দ্রুত ছুটে আসবে। পুরোপুরি দ্বগ্ধ অবস্থায় বার্ন ইউনিটের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় উক্যছাই মারমাকে। সেখানেও শিক্ষক আর বন্ধুদের সাথে কথা বলেছিল হাসিমুখে। শুধু বলেছিল পানি তৃষা পেয়েছে খুব’ কিন্তু সে পানি পান করতে পারেনি। তার সাথে বেষ্ট ফ্রেন্ডসহ আরো কয়েকজন একই জরুরী বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। একে একে সবাই প্রাণ ঝড়ে গেছে। কিন্তু উক্যছাই তখনই বাবা আসবে এমন প্রতিশ্রতি নিয়ে প্রায় ৭ ঘন্টা মৃত্যু সাথে লড়াই করেছিল। পাশে থাকা তার খালাকে বলেছিল আমাকে যেতে হবে’ আমি আর বাঁঁচবো না। বাবা না আসার পর্যন্ত জ্বালাপোড়া নিয়ে ধৈর্য ধরে ছিল। বাবা আসার পর দিবাগত রাত আড়াইটায় দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে যান উক্যছাই মারমা।
উক্যছাই মারমা রাঙ্গামাটি জেলা রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া খেয়াদং পাড়ায় জন্মগ্রহন করেছিলেন। পরিবারে একমাত্র সন্তান উক্যছাই মারমা। ছোটবেলায় ছিলেন শান্তশিষ্ট, নম্র ভদ্র ছিলেন মেধাবীও। এলাকার মানুষ ও বন্ধুবান্ধব তাকে ‘এরিকশন’ নামেই চিনত। বাঙ্গাহালিয়া পাহাড়িকা স্কুলে প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু হয়। সেখান থেকে ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে। এরপর তাকে ঢাকা ক্যাডেট স্কুলের পরিক্ষা দিতে গেলে সেখানে চান্স না পেয়ে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের ষষ্ট শ্রেনীতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। এরপর শুরু হয় শিক্ষা জীবনের স্বপ্ন ছোয়ার দৌরাত্ম।
উক্যছাই মারমা শিক্ষা জীবনের নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। আর আত্বীয় স্বজনদের স্বপ্ন ছিল সেনা কর্মকর্তা বানানো। পড়ালেখার পাশাপাশি তার গিটারে শব্দ যেন মন কেড়ে নেই শিক্ষক -আত্বীয়স্বজনসহ বন্ধু-বান্ধবের মাঝে। সবচেয়ে পছন্দে ছিল গিটার বাজিয়ে গান করা আর প্রিয় খাবার হিসেবে তালিকা ছিল বিরিয়ানি। সে গিটার সুর কিংবা প্রিয় খাবারের তালিকা এখন চিরতরে বিদায় নিয়েছে। আর শোনা যাবে না গিটারের শব্দ, শোনা যাবে তার মধুর সুরে গানের সুর। শুধু রয়ে গেছে তার রেখে যাওয়া স্মৃতিচারণ।
গত সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটায় মৃত্যু হয় উক্যছাই মারমা। মৃত্যু খবর শোনার মাত্রই ছেলেকে হারিয়ে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে প্রশিক্ষণ বিমান বিধস্ত হয়ে নিহত হওয়া উক্যছাই মারমা মা ডেইজি প্রু মারমা। চোখের অশ্রু ভেজার কান্নায় কণ্ঠস্বরে বলছেন বাবা কোথায় তুমি’বুকে ফিরে আয় আমার ধন’ একা কেন চলে গেলি আমাকেও সাথে নিতে পারতি’। ছেলে হারানো মায়ের আর্তনাদ দেখে পুরোপুরি স্তব্ধ প্রতিটি মানুষ। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মা ডেজিপ্রু মারমা। শোকে কাতর হয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বারবার হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। প্রতিটি সময় শুধু ছেলের দেহটিকে দেখে কান্নায় অশ্রু জ্বলে ভাসিয়েছে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ছেলে পৃথিবীতে আর নাই। সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেছে ওপারে।
ছেলের এমন মর্মান্তিক ঘটনার শোনার মাত্রই ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন উক্যছাই বাবা উসাইমং মারমা। চট্টগ্রাম থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ করে বিমানে করে ছেলের কাছে ছুটে যান বার্ন ইউনিট হাসপাতালে। সেখানে পৌছানো পর তার বাবাকে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে উক্যছাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ছেলের মৃত্যু দেখেন থমকে গেছে বাবার স্বপ্ন। চোখেমুখে নাই হাসি কান্না, চোখের অশ্রু না ঝড়লেও বুকের পাথর চেপে এক কোণে কেদেছেন বাবা উসাইমং। কারো সামনে এক মুহুর্ত প্রকাশ করেনি ছেলেকে হারিয়ে বাবা ভেঙ্গে পড়েছে।
গত মঙ্গলবার উক্যছাই মারমা নিথর মরদেহ এম্বুলেন্স যোগে গ্রামে নিয়ে আসে বাবা উসাই মং মারমা। তাকে এক পলক দেখতে ছুটে আসে আত্বীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সহ প্রতিবেশীরা। এম্বুলেন্স থেকে নামার মাত্রই কান্নায় হাউমাউ করে ভেঙ্গে পড়ে সকলেই। শোকের ছায়ায় পরিণত হয় বান্দরবান- রাঙামাটি দুই জেলার মানুষের মাঝে। কান্নায় ভেসে উঠে পুরো এলাকার মানুষ। তার এমন মর্মান্তিক ঘটনা যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না।
গতকাল উক্যছাইকে শেষ বিদায় জানাতে ছুটে এসেছে আত্বীয়স্বজন, প্রাক্তন শিক্ষার্থীর, শিক্ষকসহ বন্ধুরা। বন্ধুরাও এমন খবর পেয়ে সকলেই মর্মাহত হয়েছে। তারাও হারিয়েছে একই স্কুলের পড়া প্রকৃত বন্ধুকে। যে বন্ধুর সাথে খেলাধুলা পাশাপাশি গিটার সুরে গানে ভেসে উঠত বন্ধুদের আড্ডায়। আজ সে বন্ধু চিরতরে বিদায় নেয়ায় চোখের জল ফেলেছেন বন্ধুরাও। তারাও জানে তাদের বেষ্ট ফ্রেন্ড আর কোনদিন ফিরে আসবে না, কখনো আর বেজে উঠবে না গিটারের সুর জমবে না আর গানের ছন্দ। শুধু পড়ে থাকবে তার বাজানো গিটার।
গতকাল বেলা তিনটায় নিজ জন্মভূমিতে বৌদ্ধদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে তার ক্রিয়াকরন সম্পন্ন করা হয়। এসময় ছেলেকে বিদায় দিতে ভেঙ্গে পড়ে মা ডেইজি প্রু ও বাবা উসাই মং মারমা। প্রতিবেশীরা কান্নায় অশ্রু ভেজা নিয়ে চিরতরে বিদায় দিয়েছে উক্যছাই মারমাকে। আগামী প্রজন্মের ভালো ঘরে জন্মগ্রহণ করুক এমন আশির্বাদ জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।
উক্যছাই বা এডিকশন সাথে ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের একই সাথে পড়ালেখা করেছিল মংটিং তো, ছাই শৈ অং মারমা, মো শাহরিয়া জামিল সাফোয়ান, রায়ান বড়ুয়া, জাহেদ ইবনে আশরাফ ও সিলভার বম। নিজ বন্ধুকে শেষ বিদায় জানাতে এক পলক দেখতে এসেছেন তারা।
কান্নায় জর্জরিত কন্ঠস্বরের বন্ধুরা বলেন, এরিকশনে স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হওয়া।