পাহাড়ের আদিবাসীদের আস্থা রাইস ব্যাংক

0
15

আকাশ মারমা মংসিং।।বান্দরবান।।

পাহাড়ের কঠিন বুক খুঁড়ে অনেক কষ্টে ফসল ফলান তারা। সেই ফসল নষ্ট হয়ে যায় খরা কিংবা ইঁদুরবন্যায়। আবার টানা বর্ষায়ও পিছল পাহাড়ে ফসল উৎপাদনের কাজ যায় আটকে। ফলে প্রকৃতির কাছে আসলে জিম্মিই হয়ে থাকেন পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীরা। শুধু কি তাই জুমের ফসল ভালো না হলে নানা সমস্যা সম্মুখীন পড়তে আদিবাসীদের। যার কারণে দুর্গম এলাকার বসবাসরত আদিবাসী জুমিয়াদের একমাত্র আস্তা রাইস ব্যাংক।

প্রত্যান্ত অঞ্চলের বসবাসরত মানুষদের চাহিদা সামান্যই। নিজেদের উৎপাদিত ফসলে দু বেলা দু মুঠো আহার। কাজ থেকে ফিরে এসে পরিবার কিংবা স্বজনদের সাথে আড্ডা আর রাতে ঘুমিয়ে পড়া। কিন্তু পাহাড়ের দেবতা যে সব সময় প্রসন্ন থাকেন না! তাই তো প্রতি বছর কষ্টের সেই ফসল ঠিকমতো ঘরেও তুলতে পারেন না এই মানুষগুলো। তাছাড়া মৌসুমে আবাহাওয়া অনুকুলে থাকলে ভালো ফলন হলে মুখের হাসি জুটে নয় বুক ভরা কান্না নিয়ে পাড় করতে হয় বছর জুড়ে।

দুর্গম বসবাসরত দুর্ভোগে পোহাতে না হয় এ অবস্থায় বান্দরবানের সাত উপজেলার পাহাড়ের আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়ায় ইউএনডিপি। ৫৮৪টি রাইস ব্যাংকের মাধ্যমে আপৎকালীন খাদ্য মজুতের পদ্ধতি শেখানো হয় প্রকৃতির এই সন্তানদের। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে জুমের ধান জমা রাখছেন ব্যাংকে। যে ব্যাংক বিপদেআপদে সাহায্য হাত বাড়াতে পাশে থাকে দুর্গম বসবাসরত মানুষের পাশে। এই ব্যাংক থেকে সঞ্চয় রাখা ধান যে কেউ ধার করে চালাতে পারে। পরবর্তীতে আবার ফেরত দিতে হয় ধার নেয়া ধানগুলো।

‘রাইস ব্যাংক’ হলো ধানের মজুতের একটি সম্প্রদায়ভিত্তিক সঞ্চয়স্থান, যা মূলত জুম চাষিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখান থেকে তারা ফসল কাটার আগে খাদ্য সংকটের বার্ষিক তিন মাসের সময়কালে চাল ধার করতে পারেন। জুমের ফসল ঘরে তোলার পর আবার তা শোধও করে দেন। সহজ শর্তে চাল পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো। নেতৃত্ব আর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে অধিকাংশ রাইস ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের বড়মদক এলাকায় দুটি রাইস ব্যাংক কাজ করছে ১৮ বছর ধরে। এগুলো জুমিয়াদের খাদ্য নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মুলত প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে মজুতের চাল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় সবাই ঘরে ঘরে নতুন জুমের ফসল নিয়ে আসেন। কিছু ফসল জমা রাখেন রাইস ব্যাংকে। যে কেউ ব্যাংক থেকে প্রতিবার ১০ থেকে ৫০ মণ চাল ধার করতে পারেন, যা প্রতিটি ১০ হাঁড়ির বিপরীতে অতিরিক্ত তিনটি পাত্র দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। রাইস ব্যাংক চাল বিক্রি করে আবার নগদ ধারও দেয়। ধার করা নগদ অর্থ প্রতি ১০০০ টাকায় অতিরিক্ত ১০০ টাকা দিয়ে দিতে হবে। আর বিশেষ ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়। যারা ধার নিয়েছিলেন, তারা নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দিয়ে দেন।

ছোট মদক ভিতর পাড়ার নারী জুম চাষি হ্লামে মারমা বলেন, ‘এই বছরের মে-জুন মাসে খাবারের ঘাটতি ছিল। আমি ধান ব্যাংক থেকে ৩০ মণ ধান ধার নিয়েছি। ফসল কাটার পর তা শোধ করেছি।’

শৈলু মং মারমা বলেন, চলতি বছরের জুলাই মাসে তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি রাইস ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। ‘কয়েক বছর জুম ঘরে তোলার আগে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এক বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এই সময়ে রাইস ব্যাংকই একমাত্র ভরসা ছিল।’

বড়মদক এলাকার একটি রাইস ব্যাংক কমিটির সভাপতি সাচিংপ্রু মারমা বলেন, বড়মদকে রাইস ব্যাংক ১৮ বছর ধরে কাজ করছে, যা জুম চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে।

রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুশৈথুই মারমা বলেন, জুম চাষি ও গ্রামবাসীরা ধানের ব্যাংক থেকে উপকৃত হচ্ছেন। প্রতি বছর জুম ধান কাটার আগে দুই থেকে তিন মাস অনেক মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়। রাইস ব্যাংক থেকে চাল ধার করে। তবে বড়মদক এলাকা ছাড়া দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের আরও মজুদ থাকতে পারে।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘রাইস ব্যাংক’ খুবই প্রশংসানীয় একটি উদ্যোগ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে সরকারি সহায়তা পৌঁছাতে কয়েক দিন বা সপ্তাহ লেগে যায়, সেখানে জুম চাষিরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজেরাই সংগঠিত হয়েছে। রাইস ব্যাংকের সঙ্গে কৃষি অফিসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here