পরিবেশ দিবসে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার পেলেন; লামার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

0
58

ডেক্স রিপোর্ট।।

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস৷ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২৩ পেল বান্দরবানের লামা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন৷ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এগ্রো রিসোর্সের কো-অর্ডিনেটর রাবিয়া নাজরীন৷ এদিন সকালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২৪ এর উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী৷ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ও বৃক্ষরোপণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়৷

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিস্তৃত কোয়ান্টামম৷ যা এখন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যদের সঙ্ঘবদ্ধ দান, আন্তরিক শ্রম ও সহযোগিতায় ২৬ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই জনপদ৷ বাংলাদেশের অন্যতম স্বাস্থ্যকর ও প্রকৃতিবান্ধব এই জনপদটি এখন প্রায় হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩০০ প্রজাতির পাখি ও ২০০ প্রজাতির প্রজাপতির নিরাপদ আবাসস্থল৷ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এখানে আড়াই সহস্রাধিক বঞ্চিত শিশু-কিশোরের একটি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, যার নাম কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ৷ আরো রয়েছে যোগ ও ধ্যানচর্চার জন্যে আত্মিক জাগরণভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম৷ এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সেবামূলক উদ্যোগ৷

কিন্তু শুরুর চিত্রটি এমন ছিল না৷ ১৯৯৮ সালে অল্প কিছু ভূমি সংগ্রহ করে শুরু হয়েছিল এ জনপদ নির্মাণের কাজ৷ সে-সময় পুরো জায়গাটা ছিল আগাছায় পূর্ণ, আর পোড়া পাহাড়৷ শতবর্ষী সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল৷ বর্ষার শেষে আগাছা নির্মূলের জন্যে পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো৷ এত অনুর্বর আর অস্বাস্থ্যকর ছিল যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় জায়গাটিকে বলা হতো ক্যাষ্টা (নিকৃষ্ট) জায়গা৷ মশা আর ম্যালেরিয়া ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী৷ তাই শুরুর দিকে গাছ লাগানো ও চারাগুলোকে বাঁচানোই ছিল অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু হাল ছেড়ে দেবে না কোয়ান্টামের কর্মীরা৷ বর্ষাকালে সারাদেশ থেকে গাছের চারা সংগ্রহ করা হলো৷ কিন্তু কর্দমাক্ত পথে গাড়ি চলাচল সম্ভব নয়৷ তাই তারা মাথায় করে চারা নিয়ে যেত৷ চারা লাগানোর পরে বর্ষা মৌসুম শেষ৷ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী মে মাস পর্যন্ত বৃষ্টি নেই৷

তখন তারা স্থানীয় টেকনিক অনুসরণ করল৷ প্রতিটি গাছের গোড়ায় মাটির কলসি দিয়ে দেয়া হলো৷ কলসিতে ছিদ্র করে কাপড়ের সলতে দিয়ে সারাদিন ধরে চারা গাছে পানি দেয়া হতো৷ ক্রমাগত বনায়ন ও যত্নায়নের ফলে রূক্ষ, ঊষর লামার কোয়ান্টামম ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠতে লাগল শীতল আর সবুজে সুশোভিত৷

পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করতে শুরু হয় ব্যাপক সবুজায়ন কার্যক্রম৷ সারাদেশের স্বেচ্ছাকর্মীদের সহযোগিতায় প্রতিবছর বর্ষায় লক্ষাধিক ফলদ, বনজ, ভেষজ ও ফুলের চারা রোপণ করা হয়৷

বর্তমানে কোয়ান্টামমে প্রায় এক হাজার প্রজাতির দেশি-বিদেশি, বিরল ও বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ রয়েছে৷ বৈলাম, কুম্ভি, কুরচি, হাড়গোজা,চালমুগরা, ধারমারা, নাগলিঙ্গম, রঙ্গন, কুসুম, মিলেশিয়া, নাইচিচি উদাল, তমাল, হিজল, পাদাউক, কেলিকদম, বান্দরহুলা, সিভিট, কামদেব, চুন্দুল, বাঁশপাতা, লোহাকাঠ, মুসকন্দ, ঢুলিচাঁপা, বরুণ, উদয় পদ্ম, হিমঝুড়ি-সহ বিভিন্ন দেশি বিরল বৃক্ষের পাশাপাশি বাওবাব, কাইজেলিয়া আফ্রিকানা, রাজঅশোক, নেপোলিয়ান হ্যাট, মাদাগাস্কার জেসমিন, সোলান্ড্রা, এজেলিয়া, মেক্সিকান ফ্লেইম ভাইন, বহুনিয়া গ্যালপিনি, ফিডেল উড-ট্রিসহ বিভিন্ন বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতির ফুলের গাছ রোপিত হয়েছে কোয়ান্টামমে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যে একদল তরুণ প্রকৃতিপ্রেমী কর্মী রয়েছে এখানে৷ তারা দেশের বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বিরল প্রজাতির গাছের বীজ ও চারা সংগ্রহ করে থাকেন৷ নিজস্ব নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে ঢাকার রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,উত্তরার রাজউক কলেজ, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ, কুমিল্লার হামদার্দ ইউনির্ভাসিটি, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে বিরল প্রজাতির চারা সরবরাহ করছে কোয়ান্টাম৷

পাহাড়ি প্রকৃতিকে ঠিক রেখে কোয়ান্টামমের প্রতিটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে আলাদা নির্মাণশৈলীতে৷ টিলার ধাপে ধাপে নির্মাণ করা করা হয়েছে এখানকার ভবনগুলো৷ এমনকি কোনো স্থানে গাছকে আবর্তিত করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে৷

কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আগ্রহ ও উদ্যোগে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে ফুলের বাগান৷ যেগুলোর পরিচর্যা শিক্ষার্থীরা নিজেরাই করে থাকে৷ গড়ে উঠেছে হার্বেরিয়াম ও সীড ব্যাংক৷ এখানকার ভূপ্রকৃতিতে শৈলসারির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে অসংখ্য প্রবাহমান পানির ঝর্ণাধারা। পাহাড়ি এসব ঝিড়ির দুধারে রয়েছে বুনোফুল, ফার্ন আর অর্কিডের সমারোহ। ছুটির দিনগুলো একদল শিক্ষাথ পাহাড়ি ঝিড়ি/ ছড়ায় হার্বেরিয়ামের জন্যে নতুন নতুন উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করে থাকে৷ এখন তারা স্বপ্ন দেখছে একটি বিশ্বমানের বোটানিক্যাল উদ্যান গড়ে তোলার৷ বছরের বিভিন্ন সময়ে নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয় বিভিন্ন মেলা ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মশালা৷ এরমধ্যে ২০১৭ সালে তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেনের কোয়ান্টামম সফরে ‘সবুজায়ন মেলা’ এবং ২০২১ সালে পাখিবিশারদ ইনাম আল হকের সফরে ‘পাখি মেলা” অন্যতম৷

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ আর ভাষাশহিদদের স্মরণে এখানে নেয়া হয়েছে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ—শহিদ স্মরণে৷ ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ ও ৫ জন ভাষাশহিদের স্মৃতিতে রোপণ করা হয়েছে ১২টি শিমুল গাছ। ২১ ফেব্রুয়ারিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই শহিদ স্মরণে
পুষ্পঅর্পণ করে থাকে৷
বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংরক্ষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও সমভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে ঐখানে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here