আকাশ মারমা মংসিং।।বান্দরবান।।
বান্দরবানে পাহাড়ের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও বিচার-আচার এবং রীতিনীতি সামাজিক প্রথাগত উৎসব ঐতিহ্যবাহী ‘রাজপূণ্যা মেলা’ বা রাজার মেলা। প্রতিবছর শেষ মূহুর্তের শুরু হয় এই মেলাটি। এদিনে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী রাজকর আদায়ের মধ্যে দিয়ে রুপ নেয় এক মিলন মেলায়। কিন্তু সাত বছর ধরে বন্ধ থাকায় পাহাড়ের সংস্কৃতি মেলা এখন বিলুপ্তির পথে। ফলে এবারেও হচ্ছে না ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ১৪৭তম রাজপূণ্যা মেলা।
১৮৭৫ সাল থেকে পঞ্চম বোমাং রাজা সাক হ্ন ঞোর আমল থেকে বংশ পরস্পরায় ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ উৎসব হয়ে আসছে। এরপর থেকে বোমাং সার্কেল রাজা জুমচাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের মাধ্যমে উৎসবটি পালন করে থাকে। সাধারণত প্রতি বছর ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে উৎসবটি হয়। চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের পর নিজেদের নির্ধারিত অংশ রেখে বাকিটা সরকারের রাজস্ব তহবিলে জমা দেন তাঁরা। এই খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠানটির নামই রাজপুণ্যাহ। রাজপুণ্যাহে আদায় করা খাজনার শতকরা ৪২ রাজা, ৩৭ হেডম্যান এবং ২১ ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা হয়ে থাকে।
বোমাং রাজ পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান শহরের স্থানীয় রাজার মাঠে প্রতিবছরের শেষে বা শুরুর দিকে ৩ দিনব্যাপি রাজ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু পাহাড়ের অস্থিশীল পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারেও হবে না ১৪৭ তম রাজপুণ্যা মেলা। তবে প্রতিটি মৌজার হেডম্যানদের প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বোমাং সার্কেল। এনিয়ে ৭ বার পেছাল ১৪৭তম রাজপুণ্যা মেলা।
রাজপূণ্যা বলতে পাহাড়ের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও বিচার-আচার, রীতিনীতি সামাজিক প্রথাগত ও খাজনা আদায়ের উৎসব। বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলার ৯৫টি মৌজা এবং রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলার ১৪টি মৌজাসহ মোট ১০৯টি মৌজার হেডম্যান, আট শতাধিক কার্বারী, রোয়াজারা রাজাকে কুর্নিশ করে জুমের বার্ষিক খাজনা ও উপঢৌকন তাঁর হাতে তুলে দেন। রাজা নিজ প্রসাদ থেকে বের হলে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী বাজনার ঢোল। থাকেন রাজার সেনাপতি ও। প্রাসাদ থেকে বের হয়ে রাজার মাঠের সিংহাসনের দিকে এগোতে থাকে ঠিক তখনই প্রজারা নতুন বছরের পণ্যের ফল-মুলসহ নানান আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র দান করতে থাকেন। পরে নিজ সিংহাসনের গ্রহনের পর প্রজাদের উদ্দ্যেশে ভাষণ দেন বোমাং রাজা। পরে জমকালো আয়োজনের শুরু হয় তিনদিনব্যাপী রাজপূণ্যা মেলা।
বোমাং সার্কেল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি তিন জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে বাৎসরিক খাজনা আদায় করা হতো। ১২টি আদিবাসী সম্প্রদায় আর প্রায় ১৭৬৪ বর্গমাইল এলাকা ও ১০৯টি মৌজা নিয়ে বান্দরবানের বোমাং সার্কেল। প্রতিবছর বান্দরবানে রাজস্ব আদায়ের এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজবাড়ী অঙ্গণ পাহাড়ি-বাঙ্গালির মিলন মেলায় পরিণত হয়।
২০১৮ সালে ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠ প্রাঙ্গণে সবশেষ রাজপূন্যা মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে করোনা, রাজনৈতিক, নির্বাচন,পাহাড়ের যৌথ অভিযানসহ নানা সমস্যার জটিলতা কারণে দীর্ঘ সাতবছর ধরে রাজপূণ্যা মেলা অনুষ্ঠান হয়নি। চলতি বছরেও পাহাড়ের সমস্যা কারণে রাজপূণ্যা মেলা না করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোমাং সার্কেল। তবে আগামীতে পাহাড়ের রাজপূণ্যা মেলা হবে কীনা সেটি এখনো বলতে পারছেন নাহ বোমাং সার্কেল।
পাহাড়ের মানুষরা বলছেন, সামাজিক প্রথাগত রীতিনীতি, সংস্কৃতি রাজপূন্যা হচ্ছে না দীর্ঘ সাতবছর ধরে। যার ফলে এই সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তি হতে চলেছে। তাছাড়া বান্দরবানের বোমাং সার্কেলের যে কার্যক্রম সেটিও দিন দিন ব্যহত হচ্ছে। যার কারণে পাহাড়ের যে নিয়মনীতি ও সংস্কৃতি এখন পিছিয়ে যাচ্ছে।এমনটাই হলে আগামীতে পাহাড়িদের যে ঐতিহ্য সেটা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই সংস্কৃতিতে ধরে রাখতে রাজার প্রতি বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহন করা অনুরোধ জানান সকলেই।
মুইক্রা, ক্যামংথোয়াইসহ বেশ কয়েকজন বলেন, বান্দরবানে রাজপূণ্যা আর হচ্ছে না। এভাবে দিন দিন নিজেদের সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। দীর্ঘ যুগযুগ ধরে রাজার মাঠে যে অনুষ্ঠান রাজপুন্য মেলা হত সেদিন আনন্দে ভরে উঠত। আর এই দিনে সকলের মাঝে উচ্ছ্বাস হত। কিন্তু এখন সেই উচ্ছ্বাস দুরের কথা হারাতে বসেছি সে ঐতিহ্য রাজপূণ্যা মেলাকে। আমরা চাই এই অনুষ্ঠান পূণরায় চালু হোক এটাই দাবি।
বান্দরবান বোমাং রাজা সহকারী সচিব অং জাই খ্যায়াং বলেন, ২০১৯ থেকে এই পর্যন্ত ৭ বছর নানা সমস্যা কারণে রাজপূণ্যা হয়নি। আর এই বছরে পাহাড়ের সমস্যা কারণে না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে বোমাং সার্কেল।
এব্যাপারে বোমাং সার্কেলের ১৭তম বোমাংগ্রী উ চ প্রু চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবছরও রাজপূণ্যা মেলা হচ্ছে না। অনুষ্ঠান না হলেও মৌজার হেডম্যানদের বলা হয়েছে খাজনা আদায় করার জন্য। তবে আগামীতে এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান করার প্রচেষ্টা রয়েছে বলে জানান তিনি।