।।সুশান্ত কান্তি তংচঙ্গ্যা আলীকদম।।
বান্দরবানের আলীকদমে ঐতিহ্যবাহী ‘ মাহা ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে: বা প্রবারণা উৎসব’ এ বছর সীমিত আকারে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎসব উদযাপন পরিষদ। প্রতিবছর এ উৎসব ঘিরে চার দিনব্যাপী বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করে আসলেও এবার পাহাড়ে ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতির’ কারণে দুদিন ব্যাপী সীমিত পরিসরে উৎসব পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। দু’দিনের উৎসবে অনুষ্ঠানসূচী থেকে বাদ গেছে বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসব।
বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জানান, আদিকাল থেকে তিন মাস ব্যাপী বর্ষাবাস (উপোস) থাকার পর পাহাড়ি মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা পূর্ণিমা) উৎসব পালন করে আসছে। কথিত আছে,বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা আকাশে ওড়ানো হয় শত শত ফানুস বাতি। নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ফানুস বাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ বা উৎসর্গ করেন ভক্তরা। মারমা সম্প্রদায় এই উৎসবকে ‘ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে’ বা প্রবারণা পূর্ণিমা হিসেবে পালন করে থাকেন।
মাতামুহুরি অনথালয় শিশু সনদ পরিচালক ও মংপাখই হেডম্যান পাড়ার বিহার অধ্যক্ষ ভদন্ত উ-উইচারা মহাথের ভান্তে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে এবার মাহা ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে: বা প্রবারণা উৎসব’ এ বছর সীমিত আকারে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবার আলীকদমে কোন বৌদ্ধ বিহার অথবা কোন গ্রাম থেকে ফানুস উত্তোলন না করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি অংহ্লাচিং মার্মা হেডম্যান জানান, আসন্ন প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে উৎসব উদযাপন পরিষদ আলীকদমে বিগত বছরের মতো তেমন কর্মসূচি গ্রহণ করেনি । এবার ফানুস উত্তোলন করা হবে না এবং কোন পাড়া বা এলাকায় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে না বলে নিশ্চিত করেন তিনি। পরের দিন বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারি ঘাট সংলগ্ন হতে কল্প জাহাজে উপবিষ্ট উপগুপ্ত অরহৎকে পূণ্যার্থীদের বন্দনার উদ্দেশ্যে যাত্রা রাখা হবে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বন্দনা শেষে কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারি সংলগ্ন মাতামুহুরী নদীর পাড়ে খেয়া ঘাটে নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে বিসর্জন করা হবে। এই উৎসব শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয়,আজকের বিশ্বে যারা শান্তি এবং বোঝাপড়া খোঁজে তাদের জন্য এটি একটি অনন্য উদযাপন।
এই দিকে কল্প জাহাস তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পীরা। তবে পাহাড়ের অশান্তি পরিবেশ বিরাজমান কারণে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে এবার আমেজ নেই। আজ ১৭ ই অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া দুই দিনের এই উৎসবকে ঘিরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাইরে যেমন সারা রাত পিঠা তৈরি করেন পাড়ার যুবক- যুবতীরা। তাছাড়া আলীকদমেএ উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে কল্পজাহাজ নিয়ে মাতামুহুরি নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়। এ সময় নানা রকম নৈবেদ্য ও মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধ মূর্তি দর্শন করেন পূজারীরা। ওই সময় কল্পজাহাজের পেছনে সাউন্ড বক্স মাধ্যমে উচ্চ শব্দ বাজিয়ে সর্বস্তরের মানুষ মারমাদের ঐতিহ্যবাহী গান গেয়ে ঢোল বাজিয়ে এতে যোগ দেন। এবার জনসমাগম হয় এমন অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠানকে এবার অনেক কাটছাঁট করেছেন আয়োজকেরা।
মংচিং হেডম্যান পাড়া এলাকার কয়েক জন যুবক বলেন,বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পুরো তিন মাস বর্ষাবাস পালন করার পর অপেক্ষায় থাকে এই দিনটির জন্য। কল্প জাহাজ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য অঞ্চল পাশাপাশি সারাদেশে শান্তি বয়ে আসুক এই প্রবারণা পূর্ণিমা ভগবানে কাছে প্রার্থনা করবো।
আলীকদম থানার অফিসার ইনর্চাজ ওসি খন্দকার তবিদুর রহমান বলেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসবকে ঘিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন।