বিশেষ প্রতিবেদক।।বান্দরবান।।
বান্দরবানের রুমায় বিএনপি নেতার মাধ্যমে প্রতারক চক্রে খপ্পরে খুইয়ে গেছে নিরীহ জুম চাষীদের নগদ অর্থ। দুর্গম গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের বাগান পাড়া ও পূর্ণবাসন পাড়ার বাসিন্দা ৩০ জন জুমচাষীসহ রুমা বাজারে পোল্ট্রি মুরগির এক ব্যবসায়ী প্রতারিত হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। এ ঘটনা চা দোকান থেকে অফিস পারা পর্যন্ত আলোচনা সমালোচনা ঝড় উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে ও বাগান পাড়াবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু মার্মা (৫৩) গত বুধবার (১৬জুলাই) পাড়ার লোকজনকে জানায়, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ত্রাণ সামগ্রী দেবে। ত্রাণ সামগ্রী পাইতে প্রতিজনকে ৬৬০ টাকা হারে দিতে হবে।
টাকা যারা দেবে- তারা ত্রাণ সহায়তা হিসেবে প্রতিজনকে নগদ ৪২০০টাকা, ৩০কেজি এক বস্তা চাল, তেল দুই লিটার ও এক কেজি করে লবণসহ সামগ্রী পাবার কথা জানিয়ে দেয়। সহজ সরল পাড়াবাসীরা একথায় সরল বিশ্বাসে অনেকে পরিবার প্রতি ৬৫০ টাকা হারে স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু মার্মা হাতে টাকা জমা করেন।
একই পাড়ার বাসিন্দা মংচথোয়াই (৫২) ও মংছোঅং মারমা (৪১) এ প্রতিবেদকে বলেন, ত্রাণ সামগ্রী দেবে এ কথা শুনে তারাও স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু মার্মার কাছে যান। তাদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য তাকে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে মংচথোয়াই ও মংছোঅং মার্মা এই দুইজনকে স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু মার্মা বলেন, তোমরা বিএনপি করলেও জিরী গ্রুপের নয় , তোমরা আগে থেকে মাম্যাচিং-জাবেদ গ্রুপের লোক। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বিএনপির জেরী পক্ষের লোকজনকে এই ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হচ্ছে বলে সাফ জানিয়ে দেয়। তাই টাকা দিলেও ত্রাণ সামগ্রীর তালিকায় নেওয়া সম্ভব না। একথায় নিরাশ হলেও একই পাড়াবাসীর হিসেবে বারবার অনুরোধ করার পর প্রতিজনে ৬৫০ টাকা দিয়ে মংচথোয়াই ও মংছোঅং মার্মাসহ আরো বেশ কয়েকজন তালিকাভুক্তি করা হয়। এতে বাগানপাড়া ও পূণর্বাসন দুটি পাড়া মিলে ৩০ জন থেকে ৬৫০ টাকা হারে সর্বমোট ১৯ হাজার ৫০০টাকা চাঁদা আদায় করেন বিএনপির এই নেতা ।
পরদিন বৃহস্পতিবার (১৭জুলাই) সকালে প্রতারণায় ভূক্তভোগী সবাইকে ত্রাণ সামগ্রী নিতে রুমা বাজারে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। ওইদিন (১৭জুলাই) দুপুর ১২টা পেরিয়ে গেলেও ত্রাণের কোনো হদিস না-থাকায় অসহায় ভূক্তভোগীরা বিভিন্ন জনের কাছে বিষয়টি অবহিত করে। গালেঙ্গ্যা'র পূনর্বাসন পাড়া প্রধান সিংমংউ কারবারী অভিযোগ তুলে বলেন, নিরীহ জুমচাষিদের কাছ থেকে ত্রাণ সামগ্রী লোভ দেখিয়ে প্রতিজনে ৬৫০টাকা চাঁদা আদায় করেন। আবু মার্মা এই কাজটা সহজ সরল মানুষদের নিখুঁত প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কারবারী সুইসিংউ মার্মা।
জানতে চাইলে বিএনপি আবু মারমা তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগটি অস্বীকার করে বলেছেন, বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা কোকোসিং ও গালেঙ্গ্যা মেম্বার ঙানরাউ ম্রো তাকে একটি মোবাইল নাম্বার দেন এবং নাম্বারটিতে তার সঙ্গে ত্রাণ সামগ্রী ব্যাপারে কথা বলতে বলা হয়।
আবু মার্মা'র ভাষ্যমতে, তাদের দেওয়া এই নাম্বারে যোগাযোগ করলে নিজেকে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের লোক জানিয়ে আবু মার্মাকে মুঠোফোনে তার কর্মকর্তার কথা বলে ০১৩৪০৫৮৩৭৫৭ এ নাম্বারটি দেন। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলে আবু মার্মাকে বলা হয় ভিজিডি কার্ডের ন্যায় প্রতিজন- ৩০কেজি এক বস্তা চাল, দুই লিটার তেল ও দুই কেজি ডালসহ ও নগদ চার হাজার দুইশ টাকা পাবে। তবে প্রথম পাঁচজন বাদ দিয়ে তালিকাভুক্ত অন্যজনের বিপরীতে আনুষাঙ্গিক খরচ লাগবে।
তিনি আরে বলেন, বিষয়টি জানার পর বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও থানচি উপজেলা বিএনপি নেতা হামলাই ম্রো'কে বিষয়টি সম্পর্কে মুঠোফোনে বিস্তারিত জানায়।
খামলাই ম্রো 'র কথা বলে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার পর গত ১৬ জুলাই জনৈক ব্যক্তি (প্রতারক) দেওয়া বিকাশ নাম্বার: ০১৩৪০৫৮৩৭৫৭-এ ৩০জনের জন্য প্রথমবার মোট ১৯ হাজার ৫০০টাকা বিকাশে পাঠান। টাকা পাঠানোর পর ১৭জুলাই সকালে তালিকাভুক্ত ওই ৩০জনকে নিয়ে ত্রাণ সামগ্রী নিতে রুমা বাজারে চলে আসতে বলা হয়। সেভাবে ৩০জন লোক ১৭জুলাই সকালে রুমা বাজারে চলে আসেন। বাজারে পৌঁছে মুঠোফোনে কল দিলে বলা হয়, ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে গাড়িতে রাস্তায় আসছি। বলা হয় - ত্রাণ সামগ্রী বাড়তি আনা হচ্ছে। সেগুলোও দিয়ে দেওয়া হবে। তবে এর বিপরীতে আরো ৪হাজার দুইশত টাকা জরুরি বিকাশে পাঠাতে বলা হয়। সেই টাকাও বিকাশে পাঠিয়ে দেন বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত এই আবু মার্মা। এতে দুইবারে মোট (১৯৫০০+৪২০০) ২৩ হাজার ৭০০ টাকা বিকাশে পাঠাল। দুপুর ১২টার পর বারবার যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায় ঐ জনৈক ব্যক্তির।
মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ার কথা জানাজানি হলে ভূক্তভোগীরা বিএনপি নেতা আবূ মার্মার উপর ক্ষেপে ওঠে। এতে সবার মধ্যে জানাজানি প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।
যোগাযোগ করা হলে থানচি উপজেলা বিএনপি নেতা ও আন্দোলন পারাপ্রভুক্ত জেলা পরিষদের সদস্য খামলাই ম্রো বলেছেন, গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের আবু মার্মা নামে তিনি কাউকে চিনেন না। অযথা তাকে কেন টাকা উত্তোলন করতে বলব? পাল্টা এই প্রশ্ন ছুড়লেন তিনি।
একই দিনে গত ১৬জুলাই এই প্রতারক চক্রের ঘটনায় দশ হাজার ২০০টাকা খোঁজিয়েছে- সদর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ও পোল্ট্রি মুরগির ব্যবসায়ী রতন কর্মকার। তিনি নিজেকে রুমা সদর ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি জানিয়ে বলেছেন, ১৬জুলাই সকালে দোকানে এসে তাদের নেতা অংবাচিং মার্মা তাকে একটি মোবাইল নাম্বার দিয়ে কল করতে বলে।
রতনের ভাষ্য মতে, অংবাচিং দেওয়া ওই নাম্বারে কল দিলে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের কাজ করেন, এই পরিচয় দিয়ে বলে যে, ত্রাণ সামগ্রী পাইতে বিএনপি সমর্থক পাঁচজনের নাম বাছাই করে দিতে বলা হয়। একটু পরে অফিসের তার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগী রতন কর্মকারের সাথে কথা বলাই দেয় আরেকজনকে। ঐ প্রতারক নিজেকে অফিসার এবং নাম এম বাপ্পি বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, বাছাই করা প্রথম পাঁচজন ত্রাণ সামগ্রী পেতে কোন টাকা লাগবে না।
বাড়তি যদি চায় তাহলে তাদের বিপরীতে আনুষঙ্গিক খরচ বিকাশে টাকা পাঠাতে বলা হয়। এতে লোভে পড়ে রতন কর্মকার টাকা সংগ্রহ করে ১০হাজার দুইশ টাকা নাম্বারে বিকাশে পাঠায়। পরদিন (১৭জুলাই) দুপুর নাগাদ জানতে পারে যে, তিনি প্রতারকের খপ্পড়ে পড়েছেন ততক্ষণে তার দশ হাজার ২০০ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে রুমা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানালেন সদর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি রতন কর্মকার।
জানতে চাইলে রুমা যুবদলের সভাপতি অংবাচিং মারমা প্রতারক চক্রের মোবাইল দেয়ার বিষয়ে বলেছেন, এ নাম্বার থেকে নিজেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন এবং তাকে এম, বাপ্পি ধারন করে বলেন, ত্রাণ সামগ্রী পাইতে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে পাঁচজন করে তালিকা পাঠাতে । দুর্গম এলাকার কথা বিবেচনা করে নাম্বারটি তার প্রতিবেশী কোকো সিং মার্মাকে দিয়ে দিয়েছি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই চক্রটি প্রতারক। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আবার কোকোসিংকে জানিয়েছি। এর পর তার কাছে আর কোন তথ্য নাই বলে জানিয়েছেন অংবাচিং মারমা।
জানতে চাইলে কোকো সিং মার্মা বলেছেন, অংবাচিং মার্মা কাছ থেকে নাম্বারটি পাওয়ার পর গালেঙ্গ্যা ইউপি সদস্য ঙানরাউ ম্রো ও আবু মার্মাকে ওই নাম্বারটি পাঠিয়েছি, সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখতে। নিজ নিজ ওয়ার্ড থেকে পাঁচ জনের তালিকা নিতে বললেও কোন ধরনের কারোর কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয়ার কথা আবু মারমাকে বলা হয়নি বলে জানালেন কোকো সিং মার্মা।
তবে আবু মারমাকে প্রতারক চক্রের মোবাইল নাম্বার দেয়ার দাবি করলেও ঙানরাউ ম্রো মেম্বার অস্বীকার করে বলেছেন, গালেঙ্গা বিএনপি নেতা আবু মারমাকে কোন নম্বর দেননি তিনি।
রুমার অগ্রবংশ অনাথালয়ের পরিচালক উঃ নাইন্দিয়া ভিক্ষু বলেন, দুর্গম গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের সাধারণ নিরীহ লোকজনের কাছে চাঁদা উত্তোলন কেউ করে থাকলে তা হবে- চরম অন্যায়। বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে উত্তোলিত টাকা নিরীহ লোকজনের কাছে ফেরত দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সম্পাদক: হ্লাথোয়াইচিং মারমা (ভদন্ত নাইন্দিয়া থের)
নির্বাহী সম্পাদক: মংহাইথুই মার্মা
প্রধান কার্যালয়ঃ রুমা বাজার, মসজিদ গলি,রুমা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।
অফিস হটলাইন নাম্বার: +8801606760388
ইমেইল : rumabarta23@gmail.com