
সুফল চাকমা, বান্দরবান:
প্রকৃতিনির্ভর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের ঢালু ভূমিতে উৎপাদিত জুমের পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। শরৎকালের এ মৌসুমে সবুজ পাহাড় এখন সোনালী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে, জুমিয়াদের মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখ যতদূর যায়— কোথাও সবুজ আবার কোথাও হলুদাভ সোনালী পাকা ধান দোল খাচ্ছে পাহাড়ি জুমক্ষেতে। এবছর সময়মতো বৃষ্টি হওয়ার কারণে ধান তাড়াতাড়ি বপন করা সম্ভব হয়েছে, ফলে ফলনও ভালো হয়েছে তাই সবুজ পাহাড় এখন সোনালী রঙে রঙিন,
জুমচাষীদের মুখে হাসি ফুটেছে।
জুমের অনেক ক্ষেতেই ধান পাকতে শুরু করেছে। কেউ কেউ ধান কেটে নিচ্ছেন, আবার অনেক চাষি অপেক্ষা করছেন আরও কয়েকদিনের জন্য। শিগগিরই বৃহৎ আকারে অধিকাংশ এলাকায় ধান কাটা শুরু হবে বলে আশা করছেন জুমচাষীরা।
ধান কাটার আগে জুমচাষীরা মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা, চিনালসহ বিভিন্ন সাথী ফসল সংগ্রহ শুরু করেছেন। তিন পার্বত্য জেলা— বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় এখন জুমচাষীদের ব্যস্ত সময় কাটছে। জুম আবাদ ঘিরে চলছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
বর্তমানে জেলা শহরের আশেপাশে জুম আবাদ খুব একটা দেখা যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জমি সংকট ও বাগান চাষের কারণে জুম আবাদ সীমিত হয়ে এসেছে। এখন মূলত ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং সাথী ফসল উৎপাদনের জন্য ছোট আকারে জুম করা হয়।
মঙ্গলবার রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের বটতলী পাড়ার বাসিন্দা জুমচাষী ভালো কুমার তঞ্চঙ্গ্যার (৫৩) জুমে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় স্বপরিবারে এবং কয়েকজন নারী শ্রমিক নিয়ে পাকা ধান কাটতে । সাধারণত জুমের ধান গাছ মানুষের কোমর সমান হয়ে থাকে, কিন্তু এবছর তার জুমের ধান বুক থেকে গলা সমান উঁচু হয়েছে।
তিনি জানান, “এবার মাত্র দুই আড়ি জায়গায় জুম করেছি। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ার কারণে ধান ভালো হয়েছে। যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়েছে, আর রোদের সময় রোদ মিলেছে। গত বছর অনুকূল আবহাওয়া না থাকায় ফলন ভালো হয়নি, কিন্তু এবছর আশানুরূপ ফলন পাব বলে মনে হচ্ছে।”
ভালো কুমার আশা করছেন এবছর প্রায় দেড়শ আড়ি ধান পাবেন। তবে এটুকু দিয়েই কোনোমতে সারা বছর কাটাতে হবে বলে জানান তিনি।
অন্য এক জুমচাষী উৎসবলতা তঞ্চঙ্গ্যা (৫০) বলেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ‘মঙ্গোয়’ ধান আর মার্মারা বলেন ‘মংটং’ ধান হিসেবে যেটি চাষ করেন, এবছর তা ভালো ফলন দেবে। গত বছর তিনি ১আড়ি ধান চাষকরে ৭৫ আড়ি ধান পেয়েছিলেন, এবছর তার প্রত্যাশা ১৫০ আড়ি ধান পাবেন।
প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে জুমের জমি নির্ধারণ করা হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে জঙ্গল কাটা হয় এবং মার্চ-এপ্রিলে তা শুকিয়ে পোড়ানো হয়। এপ্রিল-মে মাসে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি শুরু হলে ধানসহ প্রায় ৩০–৩৫ ধরনের সাথী ফসল বপন করা হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর যারা বপন করেন তাদের ধান আগে পাকে, দেরিতে বপনকারীদের ধান পরে পাকে। আগস্টের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরুতে ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর জুড়ে চলে ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ। এরপর ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে—
২০২১ সালে আবাদ হয়েছিল ৮,৩৭৮ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল ১৩,৪৬৭ মেট্রিক টন চাল।২০২২ সালে আবাদ হয়েছিল ৮,২৯২ হেক্টরে, উৎপাদন ১১,৪১৮ মেট্রিক টন।২০২৩ সালে আবাদ হয়েছিল ৮,৫৪০ হেক্টরে, উৎপাদন ১০,৪৮৯ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদ হয়েছিল ৮,২৬৭ হেক্টরে, উৎপাদন ১২,৪৯৯ মেট্রিক টন। ২০২৫-২৬ অর্থবছর (বর্তমান মৌসুম) আবাদ হয়েছে প্রায় ৭,৩০০ হেক্টরে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০,৩৬৬ মেট্রিক টন।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এমএম শাহ নেয়াজ বলেন, “চলতি মৌসুমে জুমচাষে আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। "এপ্রিল-মে" মাসে সময়মতো বৃষ্টি পাওয়ায় এবং পরে যথাসময়ে রোদ মেলার কারণে ফলন ভালো হয়েছে। পাহাড়ে মাইক্রো ক্লাইমেট ভিন্নতার কারণে কোথাও আগে কোথাও পরে ধান পাকে। তবে এবারের জুমফসল আশানুরূপ হবে বলে আমরা মনে করছি।” তিনি আরও জানান, জুমে স্থানীয় বিভিন্ন জাতের ধান যেমন— বড় ধান, মংটং, গেলন ধান, কালো বিন্নি, লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি, নাটং প্রু ধান— আবাদ হয়। স্থানীয়রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ জাতের বীজ সংরক্ষণ করে আসছেন বলে জানান এই কৃষিবিদ।
প্রধান উপদেষ্টা: মোঃ জসিম উদ্দিন
সম্পাদক: হ্লাথোয়াইচিং মারমা (ভদন্ত নাইন্দিয়া থের)
নির্বাহী সম্পাদক: মংহাইথুই মার্মা
প্রধান কার্যালয়ঃ রুমা বাজার, মসজিদ গলি,রুমা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।
অফিস হটলাইন নাম্বার: +8801606760388
ইমেইল : rumabarta23@gmail.com